চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দেশে করোনার এক বছর: ফ্রন্টলাইনে মাঠ প্রশাসন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

৮ মার্চ, ২০২১ | ১:৫২ অপরাহ্ণ

‘যতক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে, ততক্ষণ কাজ করে যেতে হবে’-গেল বছর করোনো সংক্রমণের করুণ সময়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন চট্টগ্রামের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় লকডাউন থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, ত্রাণ বিতরণযজ্ঞে সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। মাঠে কাজ করতে গিয়ে তিনিও সপরিবারে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপরও কাজের গতি কমেনি। করোনা সংক্রমণকালে রাত-দিন মাঠে ছিলেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অন্তত ৬ মাস ধরে মাঠে ছিলেন তাঁরা। মাঠ প্রশাসনের ডিসি, ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ফ্রন্টলাইনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংক্রমণরোধে। পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে মাঠে ছিলেন তাঁরা।

লকডাউন থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ত্রাণ বিতরণ, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের দাফন-কাফনসহ সব ধরনের কাজে নেতৃত্বে ছিলেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সম্মুখ যুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে সরকারি নির্দেশ পালনে মাঠ ছিলেন প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মহানগরীর ৬ সার্কেলের এসি ল্যান্ড ও ৩৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নগরীতে সরকারি নির্দেশনা মেনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে ১৫ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় ৭২ জন কর্মকর্তা করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মাঠে ছিলেন। তাদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজ করেছেন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এছাড়া স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক, দুইজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার, এসি ল্যান্ড, সহকারী কমিশনার, জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার, উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী, সার্ভেয়ারসহ অন্তত অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নগরী ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও ঝুঁকি নিয়ে মাঠে ছিলেন। কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই।

বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আছিয়া খাতুন বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুগ্ধপোষা সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। একেকটি দিন কেটেছে ঘোর অমানিশার মতো। এছাড়াও ভয়-শঙ্কা আর আতঙ্ক তো ছিলই। সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠি।’

মাঠ প্রশাসনে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল মহানগরে। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই সপরিবারে আক্রান্ত হয়েছেন।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলাম। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘সপরিবারে আক্রান্ত হয়ে হোম আইসোলেশনে ছিলাম। নিজেদের নিরাপত্তা ছাড়াও পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তা নিয়ে টেনশনে ছিলাম। সবচেয়ে ভয় আর আতঙ্কে ছিলাম এক বছরের শিশুসন্তান নিয়ে। দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে নানাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ছিল এক কঠিন মুহূর্ত। সকলের প্রচেষ্টায় এই বৈশ্বিক মহামারী দুর্যোগ মোকাবিলায় সফল হয়েছি আমরা। অন্ধকার দিন ফুঁড়ে আজ আলো দেখছি।’

২৫ মার্চ থেকে ১০টি টিম কাজ করেছিল মহানগরীতে। মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, ত্রাণ বিতরণ, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, বাজার মনিটরিংসহ সরকারি নির্দেশনা মেনে দায়িত্ব পালনে মাঠে ছিলেন প্রশাসন। দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কায় নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত মাঠে ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। মার্চ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাজের পরিধিও।

জেলা প্রশাসনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে লকডাউন বাস্তবায়ন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ছিল চরম ঝুঁকিও। মাঠে কাজ করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি স্যারসহ অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারপরও সরকারি নির্দেশনা মেনে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীন বলেন, করোনাকালে প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, খাদ্য সহায়তা ভালবাসার থলে পৌঁছে দেওয়া, পরিবহন শ্রমিকদের সুরক্ষায় সম্প্রীতি কার্ড চালু করে নিয়মিত খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও পরিবহন সংকটের কারণে কৃষকদের সবজি পরিবহন ও বিক্রি করতে না পারায় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিল কৃষক। ফসলের মাঠে কৃষকের সাথে কর্মসূচি নিয়ে সরাসরি কৃষকের মাঠ থেকে সবজি ক্রয় কিনে ত্রাণ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও সরকারি নির্দেশনা মেনে জনহিতকর কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব কাজে ঝুঁকি থাকলেও পিছ পা হওয়ার সুযোগ ছিল না।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মাঠপর্যায়ে কাজগুলো করতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল প্রশাসন। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের উপস্থিতি বেশি ছিল। আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রশাসনকে। সব মিলিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মাঠে ছিলেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট