কোভিডকালীন টানা দেড়মাস ধরে বাড়িতে যায়নি ওরা। দেখেনি স্বজনদের চেহারা। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নিহত মানুষগুলো যেন ওদের এক একজন স্বজন। মধ্যরাতে যখন পুরো নগরী ঘুমে আচ্ছন্ন ওরা তখন করোনায় নিহত মানবদেহ নিয়ে ছুটছেন কবরস্থানে। ঈদের দিন সবাই পরিবার পরিজনের কাছে ছিল তখন ওরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ছয়জনের মৃতদেহ দাফনে ব্যস্ত ছিল। করোনায় মৃতদেহের গোসল থেকে দাফনে পথ দেখিয়েছে আল মানাহিল। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ১৫শ’র বেশি কোভিড আক্রান্ত মৃতদেহ দাফন করেছে ওরা। এরমধ্যে একশোর বেশি অন্য ধর্মালম্বী। প্রায় দুই হাজার কোভিড রোগীকে এম্বুলেন্স সেবা দিয়েছে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।
করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় স্বজনরা তাদের দাফন ও সৎকারে যখন অপারগতা জানাত তখন সে দায়িত্বও স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয় সংগঠনটি। শুধু করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের দাফন কিংবা রোগী বহন নয়। হালিশহরে একশো শয্যার একটি কোভিড হাসপাতাল চালু করেছে তারা। যেখানে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের বিনাম্যুলে সেবা দিয়েছে মানাহিল। ২০২০ সালের ৩০ মে হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন নগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান।
আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন কোভিডের শুরুতে অনেকটা স্বেচ্ছায় কাজটি শুরু করেছিল। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত সব রোগীর দাফন-কাফন কিংবা সৎকারের কাজটি এসে পড়েছে এই সংগঠনের কাঁধে। সংগঠনটির ৪০ জন কর্মী পালা করে এই কাজ করেছে। আশার কথা হলো, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ সংগঠনের একজন কর্মীরও করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেছেন, আমরা এ সংগঠনের কাছ থেকে অসাধারণ সহযোগিতা পেয়েছি। আমরা তাদের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। দেখা গেছে, কোভিড আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে নিকট আত্মীয়ও তাদের ত্যাগ করেছে। কিন্তু সেখানেই নিঃসংকোচে হাজির হয়েছে আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
জানা যায়, এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়া আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মী ওই সময়ে নিজ বাড়ি যাননি। চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নগরীর মোটেল সৈকতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। পুরো একটি ফ্লোরে কর্মীরা এক কক্ষে একজন করে থাকেন। সেখানে অবস্থান করে তাঁরা পালা করে কাজ করেন। বর্তমানে তিনটি এম্বুলেন্স ও দুইটি মাইক্রোবাসে করে করোনা রোগী এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে আনা নেওয়া করা, করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও তা নির্দিষ্ট ল্যাবে দিয়ে আসা এবং মরদেহগুলো উদ্ধার করে দাফন কিংবা সৎকার কাজে ব্যস্ত আছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। অনেকটা প্রচারবিমুখ থেকেই কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা। গত বছরের ঈদুল ফিতরের দিন করোনা আক্রান্ত হয়ে ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায় সাতজন এবং পরদিন ছয়জনের মরদেহও প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা দাফনের ব্যবস্থা করে। লাশের মাঝেই কেটে যায় তাদের ঈদের দিন।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন জমির উদ্দিন বলেন, কোভিড- আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর একজন লোককে হাসপাতাল থেকে নিয়ে কবরস্থান কিংবা শ্মশানে দাফন করা একটা বড় কর্মযজ্ঞ। এখানে প্রতিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়। দাফন শেষে পিপিই পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তিনি বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষটি মুহূর্তের মধ্যেই সবার পর হয়ে যান। অথচ এক মুহূর্ত আগেও তিনিই ছিলেন বাড়ির অর্থের একমাত্র যোগানদাতা। পরিবার পরিজনদের ত্যাগ করা ওই লোকটির কাছে তখন আমরা পরিবারের সদস্য হয়ে হাজির হই। এটা আমাদের বাবা মায়ের শিক্ষা।
যেভাবে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু : আল্লামা জমির উদ্দিন নানুপরী ফটিকছড়িতে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০১১ সালে মারা যান। তাঁর সাত ছেলে একসঙ্গে বসবাস করেন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন জমির উদ্দিন বলেন, আমার মায়ের বসয় ৮৫ বছর। মূলত মায়ের নির্দেশেই আমরা এই কাজে নেমেছি। কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল ও পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হতো। এরপর শুরু হয় আমাদের কার্যক্রম। তিনি বলেন, রোগী মারা যাওয়ার পর কেউ আর তার পাশে যান না। ফলে অক্সিজেন খোলা থেকে শুরু করে দাফন ও গাড়িতে তোলা এবং সবশেষে জানাজার নামাজ পড়াসহ যাবতীয় কাজ আমরাই করে থাকি। আমার ভাই আল্লামা ফরিদ উদ্দিন জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও মারা গেছেন। তাদের নিজ নিজ ধর্মমতে সৎকারের কাজ আমরা করেছি।
পূর্বকোণ/এএ