ডিসেম্বর ২০১৯। পৃথিবীর বুকে হঠাৎ যেন নেমে এসেছে বিষন্নতা। বলছি অন্য এক পৃথিবীর ইতিহাস। ২০১৯ চীনের উহান প্রদেশ, অজানা এক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ, বাড়ছে মৃত্যু, বাড়ছে আতঙ্ক। অদৃশ্য এক ভাইরাস, বাতাসের চেয়েও দ্রুত ছড়াচ্ছে, সংক্রমিত হচ্ছে কেবল মানুষ, মৃত্যুই যার পরিণতি। সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে উহানের দিকে।
বাংলাদেশ বসে আমি ভাবছি দেশ আর আমাদের জনগনের কথা। চীনের সাথে আমাদের বানিজ্যিক সম্পর্ক আছে, আসা যাওয়া আছে, তা ছাড়া উহানে আটকা পড়েছে অনেক বাঙালি, যাদের ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। যে কোন মুহূর্তে করোনা ভাইরাসে ( কোভিড ১৯) আক্রান্ত হতে যাচ্ছে আমাদের দেশ, বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো।
মহামারী মোকাবেলার জন্য চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা দেয়া হলো। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো করোনার ফোকাল পার্সন হিসেবে।
হাসপাতালের তত্তাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ সাহার তত্ত্বাবধানে এক সেমিনারে সিন্ধান্ত হলো ১০০ শয্যার প্রস্তুত করার। মেডিসিন ওয়ার্ডের ৫০ শয্যা আর শিশু ওয়ার্ডে ৫০ শয্যার প্রস্তুতিও শুরু হয়।
প্রথমেই নতুন রোগী ভর্তি বাতিল করা হলো। ভর্তি রোগীদেরও সুস্থ হওয়া সাপেক্ষে ছুটি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলাম। কিন্তু কি নিয়ে লড়াই করবো? কোন রকম সুরক্ষা সামগ্রী নেই, প্রশিক্ষণ নেই, নেই পর্যাপ্ত লোকবলও। ইবোলা ভাইরাসের সংক্রামণের সময়কার কিছু পিপিই ছিল, তাই ভরসা। কিন্তু সেগুলো এতো মোটা, গরমে দীর্ঘ সময় পরে থাকা কষ্টকরও। ঢাকা থেকে কোন প্রশিক্ষণ টিমও আসেনি। ঠিক করলাম ইউটিউব দেখে নিজেরাই প্রস্তুতি নেব। ডা. প্রসূণ ইউটিউব দেখে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের শেখালেন কি করে পিপিই পরতে ও খুলতে হয়, কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব।
৮ মার্চ, বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। আমাদের ছুটি বাতিল, কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় থাকলো না। তখনো সরকারী কোন সুরক্ষা সামগ্রী আসেনি, তাই আমার কলেজ গ্রুপ সিসি ৯০ কে অনুরোধ করলাম সুরক্ষা সামগ্রী যোগান দিতে। অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। বন্ধুরা আমাদের পিপিই, ফেসশিল্ড, গগলস্ধসঢ়; এন ৯৫ মাস্ক ( যদিও তখন মাস্কগুলো ততটা উন্নত নয়) দিল। তা নিয়েই কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিলাম। সারাদেশ লকডাউন করা হলো। গাড়ি নেই, হাট বাজার, দোকান বন্ধ। পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে অন্যত্র পাঠিয়ে একাই বাসায় থাকছি। কখনো হেটে, কখনো রিকশায় অফিস আসছি। সবারই একই অবস্থা। সন্ধ্যায় শহর ভুতুড়ে রুপ ধারণ করেছে। এপ্রিলে এলো প্রথম রোগী। মেহেদীবাগ নিবাসী মুজিবুল হক। পর্যাপ্ত সুরক্ষা না থাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর কাছে যাচ্ছিল না। আমি, ডা. মেহেদী, ডা. অজয়, ডা. জামাল, ডা. অরুনাভ রোগীর ওয়ার্ডে গেলাম। বুঝলাম যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে, ৬ ফুট দূরত্ব থেকে, কম সময় রোগীর কাছে গেলে সমস্যা হচ্ছে না। আর অন্যান্য ডাক্তার, নার্সরাও ভরসা পাচ্ছে।
প্রতিদিন সকালে টিমের সাথে আলোচনা করতাম, কীভাবে কাজের সমন্বয় করবো। সিদ্ধান্ত নিতে ডা. অসীম স্যার, ডা. আশফাক, ডা. শাহীন, ডা. অজয়, ডা. রাজদ্বীপ, ডা. মৌমিতাসহ অনেকেই পারস্পরিক মতবিনিময় করে কাজ করতাম। প্রতিটা দিন রোগীর খাদ্য থেকে শুরু করে চিকিৎসা সামগ্রীসহ অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ দিতে হতো, তদারকি করতে হতো। সবচেয়ে বড় সংকট ছিল অক্সিজেন। মাত্র ৪৮টা সিলিন্ডার দিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। যদিও ১০০ শয্যার জন্য ২০০ সিলিন্ডার খুব প্রয়োজন ছিল। একে অপ্রতুল অক্সিজেন সিলিন্ডার, আবার এইসব সিলিন্ডার দিনে প্রায় তিনবার রিফিল করতে হতো। অনেক সময় গভীর রাতেও সিলিন্ডার রিফিল হয়ে আসতো। অক্সিজেনের জন্য মানুষের হাহাকার ছিল ভয়াবহ। এমনও হয়েছে অক্সিজেন নিয়ে গাড়ি আসা মাত্র কাড়াকাড়ি, কে আগে অক্সিজেন নিবে। ধীরে ধীরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়লো। বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিগত সাহায্যে পাওয়া গেল অনেক সিলিন্ডার।
আমাদের হাসপাতালেই একমাত্র করোনা আইসিইউ ছিল ১০ শয্যার। প্রথম রোগী আসার ১৫ দিনের মধ্যে আইসিইউ ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু আইসিইউতে তখনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। আইসোলেসন এ ভর্তি ছিল এক ডাক্তারের ছোট ভাই। একদিন ভোর রাতে সিলেন্ডারের অক্সিজেন শেষ। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে তার। আমাকে জানানো হলো, কিন্তু কি করবো তখন? ভীষণ সংকট। আমাদের অফিস সহযোগী তারেক নিজে অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে আইসোলশন এ দিয়ে আসে। রক্ষা পায় জীবন। যেখানে তখন খুব আপন কাউকে ভর্তি করিয়ে ভুল ফোন নাম্বার দেওয়া হচ্ছে, ঠিকানা ভুল দিচ্ছে, দেখতে আসে না, খোঁজ নেয় না, সেখানে আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা প্রতিদিন ৫০/ ৬০ টা সিলিন্ডার কাঁধে করে পৌঁছে দিচ্ছে প্রয়োজন মতো। ৫/৬ মাস বেতন পর্যন্ত পায়নি তারা। তবুও কাজ করে গেছে। শুধু কি তাই হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদের নিজ বাসায় যেতে আসতে হেনস্তা হতে হয়েছে, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন অনেকে। বাসা ছাড়ার হুমকির কারণে কাজে আসতে চাননি কেউ কেউ। এমনি কি অনেক ডাক্তারকেও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে।
এপ্রিল থেকে প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ ঘণ্টা ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি কোন ডাক্তার। আমার অবস্থা ছিল আরো করুণ। সমানে রোগীদের ফোন আসতো। হয়তো কোন ফোনে দু-মিনিট কথা বলছি, ২৫টা মিসকল এসে গেছে ততক্ষণে। অনলাইন, অফলাইনে সরাক্ষণ চিকিৎসা সেবা, পরার্মশ দিয়ে যাচ্ছি। পদস্থ কর্মকর্তা থেকে সাধারণ জনগণ, মিডিয়া কর্মী থেকে ডাক্তার, সাংবাদিক, নিজের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু , সারাদিন ফোনে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে আইসিইউ, আর আইসোলেশনের রোগীদের তদারকি। এসব করতে গিয়ে নিজের আহার বিশ্রাম ভুলে গেছি, ভুলে গেছি আমি কেবল ডাক্তার নই, মানুষও।
হাসপাতালে গরম পানি, খাবার পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ ছিল না। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছে লায়ন্স ডা. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন এবং কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসীন ভাই। সহযোগিতায় ছিল কোকাকোলা কোম্পানি, যারা এখনো পর্যন্ত খাবার পানির সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন। ডাক্তারদের খাবার সরবরাহ করছেন বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিবর্গ। এ বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ডা. আশফাক। তিনি নিয়মিত এ ব্যাপারে খোঁজ রেখেছেন, তদারকি করেছেন নিরলস ভাবে। কোভিড সংকটকালীন অবস্থায় আমরা বেশি কষ্ট পেয়েছি কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি শেষে কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থাপনায়। লোক প্রশাসন কেন্দ্র (কাজীর দেউড়ি) এতো বেশি অসহযোগিতা করেছে যে, তা বর্ণনাতীত। জেলা প্রশাসনের অনুরোধ সত্ত্বেও তারা কোন ক্লিনার, গার্ড এমনকি খাবারেরও ব্যবস্থা করেনি। বরং কোয়ারেন্টাইনে থাকা ডাক্তার, নার্সদের বারান্দায় দাঁড়াতে দেখলেও অভদ্রতা করতো। এতো অপ্রতুলতার মধ্যে ও আশার বাণী ছিল করোনা রোগীর সুস্থতার হার। যদিও আমরা মৃত্যু থামাতে পারিনি, আসলে সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ করোনার জন্য সম্ভাব্য কোন ঔষধতো নেই। একজন রোগীর ক্ষেত্রে যে ঔষধটা কার্যকর , অন্য রোগীর জন্য সেটা কোন কাজেই আসে না। তাছাড়া অন্যান্য জটিল রোগে ভুগতে থাকা মানুষের মৃত্যুহার কমানো সম্ভবও নয়। এটাই আফসোস। তবে সব সংকটে আমরা নিঃস্বার্থ সহযোগিতা পেয়েছি বিভাগীয় পরিচালক ( স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির স্যার এবং সিভিল সার্জন ডা. ফজলে রাব্বী স্যারের। লাশ রাখার কোন মর্গ ছিল না। প্রথম দিকে কোভিড আক্রান্ত রোগী মৃত্যুবরণ করলে তার করোনা হয়েছে কিনা, তা না জানা পর্যন্ত লাশ হস্তান্তর করা হতো না। ১৬ বছরের কিশোর যখন মারা গেল, তখন কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তার লাশ স্বজনদের দেওয়া যাচ্ছিল না, আবার রাখাও যাচ্ছিল না। এ সমস্যার দ্রুত সমাধানে এগিয়ে আসে স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। তারা ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সামনের স্টোর রুমে এসি বসিয়ে তাকে অস্ধসঢ়;হায়ী মর্গে রূপান্তরিত করে। একে তো স্বজনেরা ভয়ে কাছে আসতো না, আবার অনেক সময় স্বজনদের খুঁজেও পাওয়া যেত না। এমতাবস্থায় আল -মানাহীল এর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বরাবরই পাশে থেকেছে। লাশের গোসল, দাফন তারা নির্ভয়ে, নিষ্ঠার সাথে করে গেছে। এমনকি অনেকদূরেও তারা লাশ নিয়ে গেছে এবং পরিপূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন করেছেন।
এখনো ভাবলে শিউরে উঠি। কতোটা ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে আজ এতোদূর আসতে পেরেছি। তখন বন্ধুরা, আত্মীয়ের, অনেক শুভাকাক্সক্ষী ইফতার, সেহেরির খাবার দিয়ে যেত। আজ বিশ্বব্যাংক যাতায়তের গাড়ি দিয়েছে। এখন অনেক কিছুই গুছিয়ে নিতে পেরেছি। আজ ২৫০ শয্যার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এস আলম গ্রুপের সহায়তায় সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়েছে। হাই ফ্লো ন্যজাল ক্যনুলা বসেছে এস আলম, একে খান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়।
হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার কমিটির সভাপতি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মহোদয় নিজ উদ্যোগে আইসিইউকে নতুনভাবে আধুনিকায়ন করেছেন। তিনি সশরীরে প্রতিটি ওয়ার্ড দেখেছেন, এর সমস্যাগুলো খুঁজে তার সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তার সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল এখন একটি পরিপূর্ণ আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আরো বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার লক্ষ্যে।
কেবল ডাক্তার বা স্বাস্থকর্মী নয়, দেশের বিত্তবান , শিক্ষিত সমাজ, যাদের ক্ষমতা আছে, সামর্থ্য আছে, বিদেশের উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার, এই মহামারী বুঝিয়ে দিয়েছে নিজ দেশের চিকিৎসাখাত উন্নত করা কতটা প্রয়োজন। আমাদের জনবহুল দেশে আমরা সীমিত সামর্থ্য নিয়ে এই বৈশ্বিক মহামারীর মোকাবেলা করছি, আক্রান্তের হার কমাতে না পারলেও মৃত্যুহার কমাতে পেরেছি।
পরিশেষে বলব, অনেক ব্যাক্তি, সংগঠন এবং বিশেষভাবে বলব মিডিয়া কর্মীদের কথা, যারা নানাভাবে সাহায্য করেছেন, এই অতিমারী মোকাবেলায়।
আমাদের সামনে আরো অনেকদূর যেতে হবে, দেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থাপনা আধুনিক, যুগোপযোগী ও জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। সবাই একযোগে কাজ করলে এটা সম্ভবপর হবে।
লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ফোকাল পারসন, কোভিড ডেডিকেটেড চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল।
পূর্বকোণ/এএ