চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশের আসল আয়না

বাদল সৈয়দ 

৮ মার্চ, ২০২১ | ১২:৫৭ অপরাহ্ণ

আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কথা বলতে গিয়ে অডিয়েন্স দেখে থমকে গেলাম। ছোট কিন্তু ‘বিশাল’ অডিয়েন্স। এদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো, You can do it!

এরা বেশিরভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিএইচডি এদের কাছে জলভাত। এরপরেও এরা আরো অনেক ডিগ্রি গুলে খেয়েছেন। এদের মধ্যে বসে আছেন, নামকরা গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, আর আমি এদের শিখাবো, ‘You can do it?’

এরা তো যা করার তা করে আরো চৌদ্দ হাজার মাইল এগিয়ে আছেন। জীবনে এই প্রথম পা কাঁপতে লাগলো। তারপরও ডায়াসে যাওয়া হলো। বোধিবৃক্ষের মত শিক্ষকরা অপেক্ষা করছেন প্রাচ্যদেশীয় এ ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের যুবক কী বলে তা শোনার জন্য। কেউ কেউ নিজের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে এসেছেন। কারো হাতে নোট বুক। লিখবেন। শুধু আমিই বুঝতে পারছি না, এদের উপদেশ দেয়ার আমি কে?

এ যেন পেয়ারা গাছ বটগাছকে বলছে ‘বড় হও।’ মাইক্রোফোনের সামনে আসার পরই কে যেন একদম ভেতর থেকে কথা বলে উঠলো, ‘ইউ ক্যান নট ডু ওনলি, ইউ ক্যান চেইঞ্জ। চেইঞ্জ থ্রু কাইন্ডনেস।’ ইয়েস, ফ্রেন্ডস, উই হ্যাভ গট হোয়াট উই ডিজার্ভ, ইভেন উই হ্যাভ গট হোয়াট উই ডোন্ট ডিজার্ভ। নাও লেট আস পে ব্যাক। জীবনে যা আমাদের দরকার ছিলো, তা আমরা পেয়েছি। এমন কি যা দরকার ছিলো না তাও পেয়েছি। এখন ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আপনারা অনেক কিছুই করতে পারেন, যা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। এই পৃথিবী একজন মানুষকে যা দিতে পারে সবই আপনাদের দিয়েছে। খ্যাতি, অর্থ, সম্মান সব। এখন আপনারা যা করতে পারেন, তা হলো, ঋণ পরিশোধ, দুনিয়ার ঋণ। আর তা একমাত্র সম্ভব দয়ার্দ্র হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা দিয়ে। ‘ইউ ক্যান ডু অ্যাক্ট অব কাইন্ডনেস।’ আপনারা মায়া ছড়াতে পারেন। এটাই একমাত্র বাকি যা আপনারা করতে পারেন। অন্যসব করা হয়েছে। কিন্তু এটা না করলে অন্য সব অর্জন বৃথা। এটা না করলে মানুষ হিসেবে আমরা ব্যর্থ।‘ আমি অনুভব করছি, আমি না, আমার ভেতর থেকে কথা বলছে অন্য কেউ। আমার মনে পড়ছে আমার জননী জন্মভূমির সে-ই সব অসাধারণ মানুষের কথা, যারা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যের জন্য।যার টাকা আছে তিনি তা দিচ্ছেন, যার মেধা আছে তিনি তাই বিলাচ্ছেন, যার কিছুই নেই তিনি রক্ত জল করা শ্রম দিচ্ছেন। আমার দেশের কতো বদনাম, কতজন কত কথা বলেন, কিন্তু কেউ এসব মানুষের কথা বলেন না, যাদের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে ‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে, দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।’

আমরা কি মোহাম্মদ নেসারের কথা জানি? তরুণ এ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সারাদিন চাকুরি শেষে মেডিকেল কলেজে গিয়ে বছরের পর পর বছর অজ্ঞাত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। নিজের বেতনের টাকায়। একে ওকে ধরে হাসপাতালে এসব অসহায় মানুষের জন্য আলাদা মেডিসিন কর্নার গড়ে তুলেছেন, যেখান থেকে তাঁরা বিনামূল্যে ওষুধ পান। অসহায় অচেতন  একজন রোগী, যার স্বজন কাছে নেই, নেসার পুত্র কিংবা ভাইয়ের মমতায় তাঁর পাশে থাকেন দিনের পর দিন। এভাবে তিনি গত কয়েক বছরে প্রায় আটশ অজ্ঞাত রোগীর সেবা করেছেন। সানজানা শিরিনের নাম কি উচ্চারিত হয়?  হবিগঞ্জের এ তরুণী মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট অনেক বছর ধরে নিজের তৈরি একটি মিশনে নেমেছেন। তাহলো একজন রোগীকেও রক্তের অভাবে তিনি মারা যেতে দেবেন না। সামান্য বেতনকে সম্বল করে পুরো সিলেটে তিনি গড়ে তুলেছেন রক্তদাতাদের নেটওয়ার্ক।  তাঁর হাত ধরেই অতি দরিদ্র অসহায় রোগীরা জীবন ফিরে পাচ্ছেন।

একইভাবে আমরা শুধু পুলিশের নেতিবাচক গল্পই শুনি, কিন্তু চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার বিজয় বসাকের গল্প আমরা কজন জানি, যিনি যে এলাকায় যান সেখানকার মানুষ জানেন একজন অভিভাবক এসেছেন, যিনি শুধু নিরাপত্তা দেবেন না, এমন কি কেউ অসুস্থ হলে  পরম মমতায় হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। করোনার কঠিন সময়ে তাঁর কোলে চড়ে কত যে মানুষ হাসপাতালে পৌঁছেছেন তার খবর আমরা রাখি না, আবার পথ শিশুদের নিয়ে শহরের সেরা সুপার শপে নিয়ে ‘যা ইচ্ছে তা কেনো’ বলার মতো উদারতা নিয়ে বিজয় সারা চট্টগ্রাম চষে বেড়াচ্ছেন- আমরা বিজয়ের কথা বলবো না, তাই কেউ তা জানবেও না।

পুলিশ কনস্টেবল শওকত তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ছোট্ট একটি দল গড়ে তুলেছেন যাদের কাজ হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষ, দুর্গন্ধে যার কাছে যাওয়া যায় না তার সেবা করা, হাসপাতাল পৌঁছে দেওয়া।

বাংলাদেশ তুরস্কের মানচিত্র নয়, এটা হচ্ছে অসীম কুমার রায়ের দেশ, যিনি জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করে গ্রামে শুধু স্কুল গড়ে তোলেননি, সেখানে যে দুশো বাচ্চা পড়ে তাদের খরচও তিনি বহন করেন।  কারো মাথার উপর ছাদ না দেখলে এ পঁচাত্তর বয়সী মানুষটির ঘুম ছুটে যায়, তাই জমানো সঞ্চয় ভেঙে তিনি তেতাল্লিশটি পরিবারের মাথার ওপর ছাদ বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি না থাকলে হয়তো এসব গৃহহারা মানুষের আশ্রয় হতো গাছতলা।

বাংলাদেশ হচ্ছে, মোহাম্মদ ওয়াহেদ হোসেনের দেশ, যিনি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অবসরে গিয়ে বিপন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে একটি অসম লড়াইয়ে নেমেছেন, তাঁর সাথে লড়াই করছে ইকবাল তানজির, সায়মা আকতারের মতো তরুণেরা। একইভাবে অপু মনিরুল, মোহাম্মদ এনামুল হক, প্রিয়তা বড়ুয়াসহ এক ঝাঁক তারুণ্য মরণপণ লড়াই করছেন দুস্থ মানুষের কাছে খাদ্য কিংবা ওষুধ পৌঁছে দিতে।

শেখ ইজাবুর রহমানের কথা আমরা কজন জানি? যিনি পরম মমতায় ঠিকানাহারা কন্যা শিশুদের ‘উপলব্ধি’ নামের আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তুলে তাতে বড়ো করছেন, শহরের সেরা স্কুলে পড়াচ্ছেন।

এরাই ‘বাংলাদেশ’- বিদেশে টাকা পাচারকারীরা ‘বাংলাদেশ’ নয়, আমাদের মাতৃভূমি এদের গর্ভে ধারণ করেনি। সে ধারণ করেছে ড. চন্দ্রনাথকে, যিনি আমেরিকায় আয়েশী জীবন যাপন না করে সেখানে কামানো রক্ত পানি করা টাকা ব্যয় করছেন আমাদের অসহায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য, গড়ে তুলেছেন ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’।

সামনে বসা অতি জ্ঞানী মানুষগুলোকে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমার দেশ নিয়ে হতাশ হবেন না, দয়া করে আমাদের ভুল বুঝবেন না, আমাদের দেশেই আছে তারুণ্যের উচ্ছাসে ভরা শত শত সংগঠন, যাদের ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, কিন্তু মানুষের জন্য তারা শুধু ইচ্ছে শক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করছেন। আপনারা দয়া করে তাঁদের দেখানো পথেই হাঁটুন। এক জীবনে যা পাওয়ার সব আপনারা পেয়েছেন, এবার এসেছে মায়া ছড়ানোর পালা। এ যাত্রায় ওপরে যাদের কথা বললাম, তাঁদের দেখাতো পাবেনই, এছাড়াও দেখা পাবেন, নাসিরউদ্দিনের, যিনি চট্টগ্রামে অভুক্তদের জন্য দীর্ঘদিন লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন, গড়ে তুলেছেন মুসাফিরখানা, বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র ‘হ্যালো হসপিটাল।’ সব তিনি করছেন ‘আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশনের’ ব্যানারে।

আমরা এদের কথা জানি না বলে ভাবি বাংলাদেশ স্বার্থপরতায় অস্তিত্ব হারাচ্ছে। আসলে তা না, অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে আছেন যারা ‘স্বার্থ’ শব্দটির সাথেই পরিচিত নয়, কিন্তু তাঁদের নাম আমরা জানি না এবং জানি না বলেই ভাবি আমাদের দেশে নিঃস্বার্থ মানুষ নেই। এর বিপরীতে আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, এ ধারণা মিথ্যে। এধরনের ‘সাধু’ টাইপ মানুষে আমাদের চারপাশ ভর্তি। সমস্যা হলো আমরা তাঁদের খেয়াল করি না; কিন্তু যতোই অনুচ্চারিত থাকুন, আপনাদের কাছে এদের খবর পৌঁছে না, আপনারা পান দুর্বৃত্তপনার খবর। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা আপনারা পোষেন। দয়া করে ওই সব দুর্বৃত্তদের দিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করবেন না। বিচার করুন আমি যাদের কথা বলছি তাঁদের দিয়ে। এরাই আসলে আমাদের জাতীয় বীর, যাদের গান কখনো গাওয়া হয় না।

প্রকৃত বীর হচ্ছেন তানভির শাহরিয়ার রিমন, যিনি কানেক্ট দা ডটস নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যার কেউ নেই তার আপনজন হয়ে যাচ্ছেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ৩৫ হাজার গাছ লাগিয়েছে এটা ভাবা যায়? এছাড়াও তিনি ও তাঁর দল স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে তাঁরা মানুষের মধ্যে গাছ ও বীজ দিয়ে যাচ্ছেন।

‘ড্রিমস ফর টুমরো’ এর প্রতিষ্ঠাতা জাবেদ পারভেজ প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করতে কত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য দমে যাননি। ।

রাজশাহীর ‘এসো পড়তে শিখি’ এর উদ্যোক্তা নিশাত তাসনীম তো বাচ্চা মেয়ে, এ বয়সে সে তার চারপাশের বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে, সাথে আছে। আবার সিলেটভিত্তিক সংগঠন ইনোভেটরের সমন্বয়কারী ঈশিতা ঘোষ এবং ইয়ুথ অপরচুনিটিসের ওসামা বিন নুর যৌবনের আনন্দ উপভোগ বাদ দিয়ে যেভাবে বিপন্ন মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন তার কোনো তুলনা হয় না।

আসলে বাংলাদেশ হচ্ছে এদের দেশ, যেদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য এক মুহূর্ত চিন্তা না করে জীবন বিসর্জন দেয়, যারা নিজে না খেয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ান, বন্যয় ডুবে যাওয়া জনপদে এদেশের মানুষেরাই পানিতে শুধু মাথা ভাসিয়ে আরেকজনের সাহায্যে স্রোত অতিক্রম করে এগিয়ে যান, তাঁর মাথায় থাকে খাবারের হাঁড়ি।

বাংলাদেশ হচ্ছে এদের দেশ, এদের মুখ মানেই বাংলাদেশ, এটি কোনো তস্করের দেশ নয়। আমার আয়নায় আমি কেবল এদের বাংলাদেশকেই দেখি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট