চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম কারাগারে হাজতিকে নির্মম নির্যাতন

আদালত প্রতিবেদক

২ মার্চ, ২০২১ | ২:০৬ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এক হাজতিকে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রূপম কান্তি নাথ (৪৫) নামে ওই হাজতি বর্তমানে চমেক হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। রবিবার রাতে সরেজমিনে চমেক হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের এমএক্স ১২ শয্যায় গিয়ে এ প্রতিবেদক ভুক্তভোগীর মুখ, হাতসহ সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। রূপমের অন্ডকোষে আগুনের ছ্যাঁকা দেয়ার মতো চিহ্ন পাওয়া গেছে। পুরো অন্ডকোষ, পুরুষাঙ্গসহ বিভিন্ন স্থান আগুনে ঝলসে গিয়ে মাংসপিন্ড খসে পড়ার মতো চিহ্ন দেখা যায় খালি চোখে। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, অ-কোষে গুরুতর আঘাতের ফলে সেখানে রক্তজমাট বেঁধে যায়। এরপর অন্ডকোষ গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া রোগীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

এদিকে রূপমকে হাসপাতালে ভর্তি ফাইলের একটি মেডিকেল নোটে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, মাল্টিপল ব্রুইস ইন হোল বডি।  আদালতসূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল কোতোয়ালী থানায়  রতন ভট্টাচার্য নামের এক ব্যবসায়ীর দায়ের করা জালিয়াতি ও আত্মসাতের (৪০৬/৪২০) মামলায় রূপম ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছেন। আত্মসাতের মামলায় তিনি চুক্তিমতো টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ওইদিন আদালত তাঁর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠান। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১০ টায় তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় কারাগার থেকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করেন কারা কর্তৃপক্ষ।

গত রবিবার রাতে হাসপাতালের শয্যায় রূপমের কাছে  কারাগারে কী ঘটেছিল  জানতে চাইলে তিনি চোখ খুলতে পারছিলেন না। বার বার জিজ্ঞেস করার পর অনেক কষ্টে মৃদু চোখ খুলে বলেন, তাঁরা আমাকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়েছে। এতটুকু বলেই তিনি আবারও চোখ মুদেন।  ভুক্তভোগীর স্ত্রী ঝর্ণারানী দেবী গত শনিবার এ প্রতিবেদককে জানান, আমার স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করার একদিন পর তাঁর অসুস্থ হওয়ার সংবাদ জানানো হয়। তিনি বলেন, গুরুতর আহত আমার স্বামীকে পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়েই হাসপাতালে আনা হয়।

পূর্বকোণের অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তি করার পরও দুইদিন রূপম ডান্ডাবেড়ি পরিহিত ছিলেন। রূপমের আইনজীবী বিশ্বজিত চক্রবর্তী পূর্বকোণকে বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে রূপমের পায়ে ডান্ডাবেড়ি দেখতে পাই। তিনি বলেন, এসময় আমি পাহারারত ৩ কারারক্ষীকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর ব্যাপারে জানতে চাই। তারা উত্তরে বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়েছেন। আমাদের কিছু করার নেই।

রূপমের পরিবার ও আইনজীবীর অভিযোগ, মামলার বাদি রতন ভট্টাচার্য অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার প্ররোচনায় রূপমকে কারাভ্যন্তরে নজিরবিহীন নির্যাতন করা হয়েছে। এদিকে, শনিবার চমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর রূপমের স্ত্রী এক দরখাস্ত দাখিল করেন। এতে রূপমের শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আঘাতের ধরণ মেডিকেল রেজিস্টারে সংরক্ষণ করে রাখার আবেদন জানানো হয়। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালে ছুটে এসে আমার স্বামীর সারা শরীরে আঘাতের দাগ দেখি। তার কাছে জেনেছি, কারাগারে তাঁকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ইনজেকশন পুশ করাসহ সারা শরীরে আঁচড়, কিল, ঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে।

রূপমের ছেলে চিন্ময় নাথ পূর্বকোণের মাধ্যমে তার বাবাকে নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার বাবাকে গুরুতর আহত করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কারাগারে নির্যাতিত হয়ে যাঁর নড়াচড়া করার শক্তি নেই। কথা বলারও শক্তি নেই। তাঁকে কারা কর্তৃপক্ষ ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাসপাতালে এনেছে। শুধু তাই নয়, ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে দুইদিন হাসপাতালে রেখেছে।  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি হাসপাতালে ভর্তি করার দিন ও পরের দিনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর সত্যতা পাওয়া যাবে বলে দাবি করেন।

এদিকে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের মোবাইলে ফোন করলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কারাগারের জেলার রফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করে পাল্টা প্রশ্ন করেন, কারাগারে কি কাউকে নির্যাতন করা যায়? তাহলে হাজতি এভাবে আহত হওয়া এবং অন্ডকোষ ঝলসে  যাওয়ার ঘটনা কিভাবে ঘটল পূর্বকোণের এ পাল্টা  প্রশ্নে তিনি নিশ্চুপ হয়ে যান। বক্তব্য জানতে পূর্বকোণ থেকে মামলার বাদি রতন ভট্টাচার্যের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর তাঁর মোবাইলে মেসেজ দিয়ে ফোন রিসিভ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। তার বক্তব্য চেয়ে মেসেজ দেয়ার পরও তিনি ফোন ধরেননি।

মুমূর্ষু হাজতি রোগীতে ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল পূর্বকোণকে বলেন- ডাকাতি, হত্যাসহ তিন বা ততোধিক মামলার দুর্ধর্ষ আসামিকে কারাগারের বাইরে নেয়া হলে নিরাপত্তার খাতিরে সচরাচর ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। আর কারা অভ্যন্তরে আহত হলে এমনকি আত্মহত্যাসহ যে কোন ঘটনার জন্য কারাকর্তৃপক্ষকেই জবাবদিহি করতে হয়। কারাগারে আহত হলে তার জন্য সুষ্ঠু তদন্ত  করে দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ কারাগারের ভেতরটা সবসময় নিরাপদ থাকার নিয়ম। তার ব্যত্যয় ঘটলে কারাকর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণ আস্থা হারাবে। সাবেক মহানগর পিপি এডভাকেট আবদুস সাত্তার পূর্বকোণকে বলেন, কারা অভ্যন্তরে একজন হাজতি বা কয়েদি সব সময় নিরাপদ থাকবেন। ব্যতিক্রম কিছু হলে তার জন্য কারা কর্তৃপক্ষই দায়ী হয়।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট