চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরিবেশ বাঁচানোর স্বপ্ন

তাসনীম হাসান

২ মার্চ, ২০২১ | ১:২৭ অপরাহ্ণ

স্থাপনা মানেই যেন ইট আর ইটের গাঁথুনি। কিন্তু সেই ইট তৈরির পেছনের গল্পটা যে অনেক ‘রক্তাক্ত’! কারণ, এটি বানাতে কোথাও কেটে সাফ করে ফেলতে হচ্ছে পাহাড়, আবার কোথাও তুলে নেওয়া হচ্ছে ফসলি জমির ওপরের স্তর। আর সেটিকে পুড়িয়ে ব্যবহার উপযোগী করতে ‘প্রাণ দিতে হচ্ছে’ গাছকে। তাই একদিকে কমছে পাহাড়, সবুজ বৃক্ষ আর উর্বর মাটি। অন্যদিকে আকাশে ধোঁয়ার সঙ্গী হয়ে উড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড। এমন পরিস্থিতিতে ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ সুরক্ষায় চট্টগ্রামে নতুন ধারণার কনক্রিট ব্লক নিয়ে এসেছে ‘ফখরীজ গ্রিন বিল্ডিং রিসোর্সেস লিমিটেড।’

২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ফৌজদারহাটের ফখরীজ গ্রিন বিল্ডিং রিসোর্সেস লিমিটেডের কারখানায় জার্মান প্রযুক্তির অত্যাধুনিক মেশিনে এখন তৈরি করা হচ্ছে সাত ধরনের কনক্রিট ব্লক। এগুলো তৈরিতে মাটির ব্যবহার একেবারেই নেই। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি বলে নেই পোড়ার বিষয়ও। ফলে পরিবেশ দূষণের কোনো বিষয়ই জড়িত নেই এসব ব্লক তৈরির পেছনে। উল্টো এসব কনক্রিট ব্লক একদিকে যেমন দামে সাশ্রয়ী, অন্যদিকে ইটের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। তাই ইটের বিকল্প হিসেবে এই কনক্রিট ব্লক ব্যবহার হতে পারে বুদ্ধির পরিচয়।

ফখরী পরিবারের ব্যবসায় এটি নতুন ধারণা হলেও তাঁরা চট্টগ্রামে সগৌরবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন ৭৩ বছর ধরে। সেই ১৯৪৮ সালে হাজি মোল্লা আবদুল করিম ফখরী চট্টগ্রামে এ পরিবারের ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। তাঁদের ছিল মূলত আমদানি-রপ্তানীর ব্যবসা। এরসঙ্গে ছিল বালতি তৈরির কারখানাসহ নানা ব্যবসাও। এরপর ১৯৬৭ সালে সেই ব্যবসার পরিধি বাড়ায় পরিবারটি। যুক্ত হয় পরিবেশবান্ধব অত্যাধুনিক মেশিন মেইড হোপ ক্লিন প্রযুক্তিতে ইট তৈরির কারখানা। এতদিন এসব ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত ছিল এই ব্যবসায়ী পরিবারটি। বর্তমানে এ পরিবারের ব্যবসার হাল ধরেছে তৃতীয় প্রজন্ম। তাঁদের হাত ধরেই এখন সেখানে নতুন সংযোজন কনক্রিট ব্লকের কারখানা। এসব ব্লকের কোনটি ভবন নির্মাণের দেয়াল তৈরিতে ব্যবহার উপযোগী। আবার কোনোটি বিছানো যাবে সড়ক, আঙিনা কিংবা বাস স্ট্যান্ডে। আবার কোনোটি তৈরি করা হয়েছে বাঁধের জন্য। সম্প্রতি নিজের কার্যালয়ে বসে ফখরীজ গ্রিন বিল্ডিং রিসোর্সেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসাইনী তাহের ফখরী শোনান পরিবেশ সুরক্ষায় তাঁর স্বপ্নের কথা। জানান সব পর্যায়ে এই কনক্রিট ব্লক ব্যবহার শুরু হলে কীভাবে বাঁচবে পরিবেশ।

পরিবেশ সুরক্ষা

কনক্রিট ব্লক তৈরি করা হয় তিনটি উপাদান দিয়ে। সেগুলো হলো বালি, সিমেন্ট আর পাথর। পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন হয় স্বয়ংক্রিয় আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে। ফলে মাটি কিংবা কাঠ পোড়ানোর কোনো বিষয় এখানে নেই। অন্যদিকে ইটভাটা থেকে নির্ঘত হয় বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড। আবার সেখানে ইট তৈরির মূল উপাদানই মাটি। যা আসে পাহাড় কিংবা ফসলি জমি থেকে। আবার সেই ইট পোড়াতে ব্যবহার করা হয় কাঠ। এতে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। তাই ইটের বদলে এই কনক্রিট ব্লক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়লে কমে যাবে পরিবেশ দূষণের হার।

পরিবেশ ও জলবায়ুর কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তর ইটের বিকল্প হিসেবে কনক্রিট ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। সরকার চায় ২০২৫ সালের মধ্যে ইটভাটা বন্ধ করে দিতে। পরিবেশবাদীরাও ইটভাটা বন্ধের দাবি তুলেছে। তাই এই কনক্রিট ব্যবহার ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষ¥ায় এই কনক্রিট ব্লক ব্যবহার করে আসছে বহুবছর ধরে।

সাশ্রয়ী কিন্তু অধিক টেকসই

ফখরীজ গ্রিন বিল্ডিং রিসোর্সেস লিমিটেডের কারখানায় বর্তমানে সাত ধরনের কনক্রিট ব্লক উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে আছে হলো ব্লকস, ইউনিভার্সাল পেভিং ব্লকস, ডাবল ইন্টারলুকিং ব্লক, পেভিং টাইলস, কার্ব স্টোন, ইরোসন কন্ট্রোল অথবা রিভার স্লপ কনট্রোল ব্লকস। এর মধ্যে ভবনের দেয়াল নির্মাণে ব্যবহার করা হলো হলো ব্লকের কথা ধরা যাক। এই ব্লকটি ছয়টি ইটের সমান। তাই এটি দেয়ালে স্থাপন করার সময় গাঁথুনিতে লাগবে কম সিমেন্ট। আবার এই ব্লক লাগানোর পর দেয়াল প্লাস্টারিং না করলেও চোখের আরাম। করতে চাইলেও সিমেন্টের আস্তরণ তেমন দিতে হয় না। ছয়টি ইটের ওজন যেখানে প্রায় ২১ কেজি সেখানে এর বদলে কাজ করা একটি ব্লকের ওজন মাত্র ১০ কেজি।

অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ ভার কমে যায়। ভার কমায় লোহার ব্যবহারও  কম দেওয়া যাবে। এই ব্লক শব্দ, তাপরোধী আর ভূমিকম্প সহনশীলও। আবার শীতের সময় কক্ষ গরম আর গরমের সময় রাখে শীতল। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই ব্লক লাগাতে তেমন সময় আর শ্রমিক লাগে না। ফলে তরতরিয়ে উঠে যায় স্থাপনা।  অন্যদিকে সড়ক, বাস স্ট্যান্ড, কার পার্কিং কিংবা ইয়ার্ডে ব্যবহার উপযোগী ব্লকগুলো একদিকে যেমন অধিক ওজন বহনে সক্ষম অন্যদিকে সৌন্দর্যও বাড়ায়। দামেও কিন্তু সাশ্রয়ী। ছয়টি ইটের দাম পড়ে ৬৬টাকা সেখানে হলো ব্লকের দাম ৫০ টাকা।

কেন এই কনক্রিট ব্লক তৈরির কারখানায় হাত দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে হোসাইনী তাহের ফখরীর মুখে ঘুরেফিরে আসলো পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি। তিনি বলেন, উন্নত বিশে^র শহরের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শহরের উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব ব্লকের ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। সেসব দিক বিবেচনা করে মানুষের দোড়গোড়ায় কনক্রিট ব্লক তুলে দিতে এই কারখানা স্থাপন করেছি। আমাদের কারখানায় সম্পূর্ণ জার্মান প্রযুক্তির ইঞ্জিনে এসব ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। তাই মানের দিক দিয়েও এসব ব্লক সেরা।’

কেমন সাড়া পাচ্ছেন এর উত্তরে হোসাইনী তাহের ফখরীর মুখে উচ্ছ্বাস ঝরল। তিনি বলেন, ‘বেশ ভালো। চট্টগ্রামে নানা বড় বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। সেখানে আমাদের কনক্রিট ব্লকগুলো নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আশা করছি ধাপে ধাপে সবার কাছে পৌঁছে যাব আমরা।’

অবশ্য সরকারের কাছে একগুচ্ছ দাবিও আছে এই ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, কিছু সময়ের জন্য কর অব্যাহতি এবং ভ্যাট মুক্ত করে দেওয়া হলে খরচ অনেক কমে যাবে। এতে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও কনক্রিট ব্লক তৈরির কারখানা খোলার বিষয়ে আগ্রহী হবেন। সরকারি নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সেখানে যদি কনক্রিট ব্লক ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা ইটভাটার বদলে এই ব্যবসায় নামবেন। তাতে মানুষদের মধ্যেও কনক্রিট ব্লক ব্যবহারে সাড়া পড়ে যাবে।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট