চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বর্ষা-আতংক ব্যবসায়ীদের

ইফতেখারুল ইসলাম 

২ মার্চ, ২০২১ | ১২:২৩ অপরাহ্ণ

ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এবং আশপাশের ব্যবসায়ীরা বর্ষার কথা শুনলেই আঁৎকে উঠেন। আসন্ন বর্ষা নিয়ে এখন চরম দুশ্চিন্তায় তারা। গত বর্ষায় তাদের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই তিক্ত। পানিতে ভিজে শত শত কোটি টাকার কাঁচা ও ভুষা মাল নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে চাল-ডালসহ বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য।

দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাণিজ্য কেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পণ্যের নিরাপত্তার অভাব। প্রতিটি দোকান এবং গুদামের সামনে দেড় থেকে দুই ফুটেরও বেশি উঁচু করে পাকা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। যেকোন ক্রেতাকে কোন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে হলে এই দেয়াল পার হয়েই আসতে হয়। দেয়াল পেরিয়ে গুদামে ভারি মালামাল আনা-নেয়া করতেও শ্রমিকদের বেশ বেগ পেতে হয়। মূলত জোয়ারের পানি এবং জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীরা এই উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, গত বর্ষায় দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। ভরা বর্ষা মৌসুমে এ ক্ষতি শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জোয়ারের পানি ঢুকে গুদামে রাখা মালামাল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বন্ধ ছিল বেচা-কেনাও। দিনে দু’বার জোয়ারের সময় হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের মতো পণ্য নষ্ট হয়েছে। এমনকি এসব পণ্য কোথাও সরিয়ে রাখার সুযোগও ছিল না। নোংরা পানিতে কোন ভিজে যাওয়া ভোগ্যপণ্য রোদে শুকিয়ে বিক্রি করারও সুযোগ পায়নি ব্যবসায়ীরা। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেট, হামিদুল্লাহ মার্কেট, পোড়াভিটা, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, আছদগঞ্জ, চর চাক্তাইসহ বিভিন্ন নিচু এলাকা হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। বর্তমানে স্লুইস গেইট নির্মাণের কারণে খালের মুখে বাঁধ দেয়ার ফলে জোয়ারের পানি আসছে না। কিন্তু বর্ষায় যখন বাঁধ কেটে দেবে তখন গুদাম ও দোকানপাট তলিয়ে যাবে।

কর্ণফুলী নদী নিয়ম মাফিক ড্রেজিং ও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করলেই জোয়ারের পানি থেকে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাশাপাশি নগরবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। কিন্তু দুই বছর পার হলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি।

ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের বক্তব্য :

দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহাবুবুল আলম পূর্বকোণকে বলেন, ‘ইকনোমিক ইমপেক্ট অব ওয়াটারলগিং অন লোকাল ট্রেড : দ্যা কেইস স্ট্যাডি অব খাতুনগঞ্জ, হোলসেল কমোডিটি মার্কেট চট্টগ্রাম’ শীর্ষক সমীক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ৩০০-৪০০ বছরের পুরানো এবং প্রায় ২৫০ বছর আগে নামকরণকৃত খাতুনগঞ্জে ২০০৪ সাল থেকে জলাবদ্ধতার কারণে দোকান ও গুদামের মালামাল নষ্ট হয়ে শত শত কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তিনি

চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং করা, নালা নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করা, চাকতাই খালকে নৌ-চলাচলের উপযোগীকরণ, খালের মাটি দ্রুত উত্তোলন ও গভীরতা নিশ্চিত করা, খালের দুই পাড়ে রাস্তা ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মিঠা পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাকরণ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের অনুরোধ জানান। এছাড়া রাজাখালী খালকেও গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং পানি প্রবাহ সচল রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন।

বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সøুইস গেট নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়ে বলেন, সাগরের জোয়ারের পানিতে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর এ ছাড়া কোনো পথ নেই। একই সঙ্গে খাল খনন করে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা করা না হলে এই দুর্ভোগের শেষ হবে না। অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ সগীর আহমদ বলেন, গত বর্ষায় চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জ এলাকার প্রতিটি দোকানে পানি প্রবেশ করেছে।  এসব দোকান ও গুদামে মালামাল, ভোগ্যপণ্য এবং নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর মজুত ছিল। সব নষ্ট হয়েছে। একারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমদানি করা এসব পণ্য নষ্ট হয়ে অনেক ব্যবসায়ী গুরুতর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। চাক্তাই খালের গভীরতা কমে যাওয়া জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :

জানতে চাইলে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী পূর্বকোণকে বলেন, চাক্তাই খালের চারটি অংশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। বর্ষা না আসা পর্যন্ত তাদের কাজ চলবে উল্লেখ করে বলেন, যখন বৃষ্টিপাতের কারণে কাজ করা সম্ভব হবে না তখন খালের পানি প্রবাহের বাধা অপসারণ করা হবে। আর চাক্তাই খালের মুখে যে স্লুইস গেট নির্মাণ হচ্ছে তার কাজ করছে সিডিএ। সিডিএ বর্ষায় নিশ্চয় পানি চলাচলের ব্যবস্থা করে দেবে। তাছাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এবং আশপাশের বাণিজ্যিক এলাকার নালার কাজ চলছে উল্লেখ করে বলেন, ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে সেখানে কাজ করা কিছুটা কঠিন। পুরো এলাকায় একসাথে কাজ করা যাচ্ছে না। অল্প অল্প করে কাজ করতে হচ্ছে। তবে যেটুকু কাজ হয়েছে এবার জলাবদ্ধতার সমস্যা কমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস পূর্বকোণকে বলেন, কালুরঘাট থেকে শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত ১২টি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি স্লুইস গেট নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে আরো ৫টি স্লুইস গেইট নির্মাণের কাজ। স্লুইস গেটসমূহের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

স্লুইস গেট নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব দাশ পূর্বকোণকে বলেন, রাজাখালী খালের উপর নির্মাণাধীন স্লুইস গেটের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। চাক্তাইখালের মুখে নির্মাণাধীন স্লুইস গেটের ফাউন্ডেশনের কাজ চলছে। কারণ একপাশ খোলা রেখে কাজ করতে হচ্ছে। তাছাড়া পাম্প এবং জেনারেটর আসবে। বর্ষার আগে ফাউন্ডেশনের কাজ শেষ হয়ে যাবে। পুরো কাজ সম্পন্ন করতে আরো বছর দেড়েক লাগতে পারে। তবে আসন্ন বর্ষায় যাতে বোট চলাচল করতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তখন হয়তো জোয়ারের পানি আটকানো যাবে না।

উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর ও নদী-সংলগ্ন খালের গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে ২০১০ সালের জুলাই মাসে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের সে সময়ের জেলা প্রশাসক ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আদালতের সেই নির্দেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট