চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জঙ্গল সলিমপুর: এক মশিউরে তটস্থ লাখো বাসিন্দা

নাজিম মুহাম্মদ 

১ মার্চ, ২০২১ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

তিনি যা বলেন তাই হয় জঙ্গল সলিমপুরে। তিনি সেখানে স্বঘোষিত রাজা। তাঁর কথার বাইরে কারো যাবার সুযোগ নেই। বিচার-সালিশ, অবৈধ বিদ্যুৎ, সরকারি জমি দখল-বেদখল, চাঁদবাজি, খুন, ইট-বালি, সমিতি ও শাখা সমিতির নামে চাঁদাবাজি হেন কাজ নেই তার ইশারায় হয়না। তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকে জঙ্গল সলিমপুরে বসবাসরত লাখের বেশি নারী পুরুষ। বায়েজিদ বাইপাস সড়ক হবার পর তার ভাগ্যে আসে আমূল পরিবর্তন। দ্বিগুণ উৎসাহে মেতে উঠে দখল বাণিজ্যে। সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় থেকে বছরের বছর ধরে  সে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।

তিনি হচ্ছেন হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত চাঞ্চল্যকর ছোটন হত্যাসহ ২৫ মামলার আসামি কাজী মশিউর রহমান। তাঁর রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। মশিউরের অনুসারী প্রত্যেকে একাধিক মামলার আসামি। যেমন-আল আমিন সাগর চারটি, কাউছার ৪টি, ওসমান দুটি, মিজানের ৩টি, সিরাজের ৩টি, মশিউরের ছেলে শিবলুর একটি, সায়েমের ৪টি, আরিফের ৪টি, জসিমের ২টি ও সেলিমের ৩টি মামলা রয়েছে সীতাকুণ্ড থানায়। মীর আরমান, মিজান, কাউছার ও শিবলু তার প্রধান বিশ্বস্ত সহচর। ২০১৬ সালে বাসা থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শাহাদাত হোসেন ছোটন নামে এক যুবককে। হত্যার পর লাশ মাটিতে পুঁতে রাখেন। ঘটনার ১৪ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয় মাটিচাপা দিয়ে রাখা ছোটনের কঙ্কাল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফ জানান, ছোটন হত্যার প্রধান মাস্টারমাইন্ড মশিউর। মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্তে ছোটন হত্যায় ১২ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। মশিউর ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন, রানা, সোহেল, কালু ডাকাত, ওসমান গণি, রফিক, মামুন, জাহাঙ্গীর, বরমা সায়েম ও শাহাদাৎ মেম্বার।

বিদ্যুৎ ও হোল্ডিং ট্যাক্স : অনুসন্ধানে জানা যায়, জঙ্গল সলিমপুরে এক লাখ ২৫ পরিবারের মধ্যে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে চারটি মিটার থেকে। এরমধ্যে একটি মিটার র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত ছিন্নমূল নেতা আক্কাস উদ্দিন, দুটি মশিউর রহমান ও একটি জামাল হোসেন প্রকাশ অন্ধ জামালের মালিকানাধীন। এ চারটি মিটার থেকে পুরো এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ টানা হয়েছে। সেখানে বাসা থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নেয়া হয় ১১ টাকা ও দোকানে ১৩ টাকা। যাকে বাণিজ্যিক হিসাবে অবহিত করা হয়। প্রতিটি নতুন লাইন সংযোগ দিতে নেয়া হয় ৩০ হাজার, উন্নয়ন ফি এর নামে প্রতি পরিবার থেকে নেয়া হয় মাসে ২শ টাকা। প্লট বদল ফি জমির মূল অনুসারে ক্ষেত্রভেদে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা  নেয়া হয়। প্রত্যেক পরিবার থেকে বছরে ৫শ থেকে এক হাজার টাকা ট্যাক্স নেয়া হয়।

কাজী মশিউরের বক্তব্য : কাজী মশিউর রহমান জানান, আমার বিরুদ্ধে অধিকাংশ মামলা সাজানো। ২৫ মামলার মধ্যে অধিকাংশ মামলার বাদি আদালতে গিয়ে আমার পক্ষে লিখিত দিয়ে এসেছে। সাত/আটটি মামলা আছে। তাও আশা করছি খালাস পাবো। অনেকে আমার নামে জমি দখল করে। আমার নাম ভাঙিয়ে চলে।

ছোটন হত্যা প্রসঙ্গে মশিউর বলেন, ছোটন হত্যার ঘটনায় যাদের চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছে তারা কেউ জড়িত নয়।

বিদ্যুতের ব্যবসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার নামে দুটি, জামালের নামে দুটি ও র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত আক্কাসের নামে দুটি মিটার বিদ্যুতের মিটার রয়েছে। এসব মিটার থেকে ১৬শ সাব মিটার দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগকে আমরা প্রতি ইউনিটে বিল দিই নয় টাকা। আর গ্রাহকদের কাছ থেকে আমরা প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা নিই। বাড়তি টাকা কর্মচারীদের বেতনের পেছনে খরচ হয়।

সমিতি প্রসঙ্গে মশিউর বলেন, জঙ্গল সলিমপুরে সব সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্যুতের মিটারগুলো সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।

১০ সমাজে ১১৭ শাখা : জঙ্গল সলিমপুরে সরকারি জমিতে যত ব্যবসা। সরকারি খাস জমিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস করছে এক লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি পরিবার। পুলিশের অনেক সদস্যও সেখানে জমি দখলে যুক্ত হয়েছে। পুরো সলিমপুরকে ভাগ করা হয়েছে দশটি সমাজে। এসব সমাজের শাখা রয়েছে ১১৭টি। যেমন-বৃহত্তর রাজশাহী থেকে কোন এক ব্যক্তি এসে প্রথমে বসবাস করছেন পরবর্তীতে তার বন্ধুবান্ধব স্বজনের নিয়ে এসেছেন। শাখাটির নাম দেয়া হয়েছে বৃহত্তর রাজশাহী শাখা। এভাবে ১১৭ শাখা হচ্ছে মহানগর, বহদ্দারহাট-১, বহদ্দারহাট-২, কোর্ট হিল, আগ্রাবাদ, মসজিদ কলোনি, মোহাম্মদনগর, পলিটেকনিকেল, হামজারবাগ, রৌফাবাদ, আলফালাহ গলি, মাস্টার কলোনি, তালতলা, আইসফ্যাক্টরি, শান্তিনগর, এয়াকুবনগর, উত্তর আলি নগর, বিবিরহাট, বাকলিয়া, নুরুনবী শাহ, নাছিরাবাদ তুলাতলি, চান্দগাঁও, অক্সিজেন, শুলকবহর, ভুজপুর, ময়লার ডিপো, আমিন কলোনি, দামপাড়া, রংপুর, জঙ্গল সলিমপুর, উত্তর পাহাড়তলী, চশমাহিল, মহেষখালী, নবী নগর-১, নবী নগর-২, নবী নগর-৩, চন্দ্রনগর, নিমতলা, মালিপাড়া, ঝিলের পাড়, মৌলভীপাড়া-১, মৌলভী পাড়া-২, রুবি কলোনি, গ্রিনভ্যালি, সন্দ্বীপ-১, সন্দ্বীপ-২, সন্দ্বীপ-৩, বিশ্ব কলোনি, বরফকল, সাধুরপাড়, সীতাকু–১, সীতাকুণ্ড-২, বেলতলা, ডেবারপাড়-১, ডেবার পাড়া-২, শরাইপাড়া-১, বিআরটিসি, খালিফাপাট্টি, ফুলবাগিছা, মান্দারটিলা, বাংলাবাজার-১, কাপুড়িয়া পাড়া, ছোটপুল, ধনিয়ালাপাড়া, পুরাতন ছিন্নমুল, বরিশাল-১, আমিন টেক্সটাইল, রাঙামটি, ঐক্য পরিষদ, আলি নগর, আবদুর রব, মাঝিরঘাট, মাদারবাড়ি, দুই নম্বর গেট, মাইল্ল্যার বিল, এনায়েত বাজার, চন্দনপুরা, বাঁশখালী, মুরাদপুর, ফেনী, কুমিল্লা, কর্ণফুলী, মোহছেন আউলিয়া, শাহ আমানত,চিশতিয়া,ছায়ানীড়, কলাবাগান, কাজির দেউরি, শপিং কমপ্লেক্স, আল কাউছার, বরিশাল-২, পাথুরীঘোনা, বার্মাকলোনি, আমির ভান্ডার, চন্দনাইশ, ভূমিহীন, হাতিয়া, জাফরাবাদ, ভোলা মাইনকা, উত্তর ধুরং, বৃহত্তর রাজশাহী, চন্দ্রনগর-২, লালমোহন, বার আউলিয়া, দেওয়ানবাজার, সাতকানিয়া, বরগুনা, এশিয়ান হাইওয়ে, কুতুবদিয়া, নুরনবী শাহ-২, স্টিলমিল, অলংকার, বড়–য়াপাড়া, শাহ জালাল (রহ.) মায়ের দোয়া এবং নুরুল আলম স্মৃতি শাখা।

এসব শাখা নিয়ন্ত্রণ করতে তিনটি সমিতি গঠন করেছে মশিউর। তা হলো, চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ, জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল বহুমুখী সমবায় সমিতি লি. ও চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল ও বস্তিবাসী, বাস্তুুহারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.। জায়গা জমি বেচাকেনা, আর শালিস বিচার সমাজ ও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা করে থাকেন। জমি বেচাকেনা কিংবা হাত বদল হলে এক লাখে ১০ হাজার শাখার নেতা ও ৫ হাজার টাকা নিয়ে থাকে মশিউরের নেতৃত্বে থাকা তিন সমিতি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট