চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

জীর্ণতার খোলসেই বন্দী দীর্ঘকাল

ইফতেখারুল ইসলাম

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:৫৫ অপরাহ্ণ

সুপ্রাচীন কাল থেকে খাতুনগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকা ব্যবসা বাণিজ্যের সূতিকাগার। অতীতে দেশের আমদানি-রপ্তানি তথা শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। এখনও আছে। তবে যে বাণিজ্যিক এলাকাকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা ঘুরছে শত বছরেও তার কোন অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। এখানকার সড়কগুলো এখনো গলি-উপগলির মতোই। একটি ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান অপরটির পাশ দিয়ে যেতে পারে না। পাইকারি ব্যবসার কারণে এই বাণিজ্যকেন্দ্র দিনরাত খোলা থাকে। তাই সড়কগুলোও এক প্রকার অবরুদ্ধ থাকে। কোন কোন সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়াও দুরুহ ব্যাপার। তাই এখানে কোন ট্রাফিক ব্যবস্থাও নেই। জরুরি কাজ না থাকলে কেউ এই এলাকা দিয়ে সহজে যায় না। এমনকি অন্য এলাকা থেকে সিএনজি ট্যাক্সি এবং রিকশাও সেখানে ভাড়া নিয়ে যেতে চায় না।

একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে তারা জানান, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের এই বাণিজ্যিক এলাকার প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মোগল আমল থেকে ঐতিহ্যবাহী এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রের গুরুত্ব বিবেচনায় অবকাঠামোগত কোন পরিবর্তন হয়নি। অথচ সময়ের চাহিদার কারণে এখানে ব্যবসা বাণিজ্যের জৌলুস বেড়েছে। বেড়েছে পণ্যের চাহিদা। একারণে আমদানি-রপ্তানি ও সারাদেশে পণ্য সরবরাহ কার্যক্রমও বেড়েছে। সময়ের পরিবর্তনে খাতুনঞ্জের ব্যস্ততা বাড়লেও কোন কোন সড়ক হয়েছে সংকুচিত।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, বৃহত্তম পাইকারি বাজারের বকশিরহাট-বিটালিগঞ্জ হয়ে চাক্তাই প্রথম পুল (ফুলতলা) পর্যন্ত দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার সড়কটির দুইপাশে ইংরেজ আমল হতে রয়েছে শত শত আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং হাজারো পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী। এই অংশটির নাম খাতুনগঞ্জ। এই সড়কটির প্রশস্ততা কোথাও ১৫ ফুট, কোথাও ১৮ ফুট আর কোথাও প্রায় ২৫ ফুট। ফুলতলা হতে ফিশারিঘাট পর্যন্ত মধ্যম চাকতাই পুরান রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। এই সড়কের প্রশস্ততা কোথাও ১৫ ফুট, কোথাও ২০ ফুট। চাউলপট্টি হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত আধা কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের প্রশস্ততা ১৫ হতে ২০ ফুট। চালপট্টি হতে ভাঙাপুল মোড় পর্যন্ত চাল পট্টি সড়কটিই তুলনামূলক প্রশস্ত। যার প্রশস্ততা ২৫ হতে ৩০ ফুট। সাবান ফ্যাক্টরি হতে জুলেখা আমিন উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত কোয়াটার কিলোমিটার দীর্ঘ আমিনুর রহমান রোডের প্রশস্ততা ১২ হতে ১৫ ফুট।

রাজাখালী প্রধান সড়ক চাল পট্টি হতে শাহ আমানত সংযোগ সড়কের পূর্বপার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এই সড়কের প্রশস্ততাও ১৫ হতে ২০ ফুট। এছাড়া ফাইভ স্টার গলি, সোবহান সওদাগর রোড, শেখ মোশারফ হোসেন রোড অছিমিয়া লেন, ফায়ার সার্ভিস গলি, ড্রামপট্টিসহ সবগুলো শাখা রোডের প্রশস্ততা ১০ থেকে ১৫ ফুট। আনসার ক্লাব হতে খাতুনগঞ্জ বিটালিগঞ্জ পর্যন্ত কোয়ার্টার কিলোমিটার দীর্ঘ বকসিরহাট নজিমিয়া রোডের প্রশস্ততা ১৫ হতে ২০ ফুট। খাতুনগঞ্জ হতে কমিশনার মাহাবুব গলি পর্যন্ত কোয়ার্টার কিলোমিটার দীর্ঘ পোড়াভিটা ওয়ার্ড অফিস লেনের প্রশস্ততা ৮ হতে ১০ ফুট। চাকতাই খালের পাড় দিয়ে মিয়াখান নগর ফুলতলা সড়কটির প্রশস্ততাও ১০ হতে ১২ ফুট। চাকতাই রাজাখালী খালের পাড়ে রাজাখালী একসেস রোডের অবস্থাও একই। খাতুনগঞ্জ হতে আছদগঞ্জ পর্যন্ত কোয়ার্টার কিলোমিটার দীর্ঘ রামজয় মহাজন লেইনের প্রশস্ততা ১৮ থেকে ২০ ফুট।

সরেজমিন দেখা গেছে, চান্দমিয়া লেইন, ওসমানিয়া লেইন, বাঁশঘাটা লেইনগুলোতে রয়েছে অসংখ্য ভোগ্যপণ্য এবং ভোগ্যপণ্যের ব্যবহৃত কার্টন, খালি বস্তা, পলিব্যাগ এবং ব্যবসায়ী পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন উপকরণের ব্যবসা। ওসমানিয়া লেইন ও আছদগঞ্জের একটি অংশে শুঁটকি ব্যবসা এবং আরেকটি অংশে লোহা ও লৌহজাত পণ্য এবং হার্ডওয়ার মার্চেন্ট এক বিশাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্লাহ মিয়া বাজারে রয়েছে কাঁচাপণ্য যেমন, পেঁয়াজ রসুন, আদাসহ মসলাদির ব্যবসা। এছাড়া রয়েছে তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, মশলাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

খাতুনগঞ্জের শাখা রোড আমির আলী রোডের আমির মার্কেটে রয়েছে সুতা ও কাপড়ের প্রধান আমদানি রপ্তানির ব্যবসা। খাতুনগঞ্জ প্রথম পুল থেকে মধ্যম চাকতাই লোহারপুল পর্যন্ত রয়েছে পেঁয়াজ রসুন আদা, আলুসহ বিভিন্ন কাঁচা পণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চাক্তাই লোহারপুল থেকে নয়া রাস্তা, পুরান রাস্তা এবং ভাঙাপুল পর্যন্ত রয়েছে চার শতাধিক চাউলের আড়ত। সোবহান সওদাগর রোড, শেখ মোশাররফ হোসেন রোড, রাজাখালী রোডে রয়েছে রাইসমিল, ময়দার মিল, সেমাইর মিল, লাকড়ির মিল, লবণের মিলসহ বিভিন্ন ছোটখাটো কয়েকশতাধিক কলকারখানা এবং মুদির দোকান। আমদানি-রপ্তানি ও পাইকারি ব্যবসার কারণে এই বাণিজ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক আসে। এছাড়া এখান থেকে বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছানোর জন্য হালকা ও মাঝারি পরিবহন এখানে পণ্য নেয়ার জন্য আসে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বাণিজ্য কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়রের কাছে তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে বার বার গিয়ে আবেদন নিবেদন করেছেন। চউক চেয়ারম্যান এবং চসিক মেয়র খাতুনগঞ্জে এসে ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন অবকাঠামোগত উন্নয়নের। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।

জানতে চাইলে ৩৫ নম্বর বকসিরহাট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক পূর্বকোণকে বলেন, এখানে রাস্তা-ঘাট সম্প্রসারণ হয়নি। অপরদিকে, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। মাটি খুঁড়ে ফেলে রাখার কারণে যানজট আরো তীব্র হচ্ছে। সড়ক সম্প্রসারণে সিটি কর্পোরেশন কিংবা সিডিএ’র পক্ষ থেকে উদ্যোগ না নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্প্রসারণ করতে হলে ভূমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট