চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

আগামীর চট্টগ্রাম: উন্নয়ন প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা

ইফতেখার হোসেন

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ৯:১৬ অপরাহ্ণ

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ঐতিহাসিক কর্ণফুলী নদীর তীরে ১১৫২ বর্গকিলোমিটার জুড়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিস্তৃত। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপার সম্ভাবনার নগর এই চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলের পাহাড়-সমতল ভূপ্রকৃতি, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, কর্ণফুলী নদীর অববাহিকা, দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে অবদান, পর্যটন, সমুদ্র বন্দর সবকিছু মিলিয়ে নিঃসন্দেহে এটি একটি সম্ভাবনাময় নগরী।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রোট্রেন্ডের সমীক্ষা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫১ লক্ষ ৩৩ হাজার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.২৫%। আর বেসরকারিভাবে চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ৬০ লক্ষেরও অধিক। এই জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগর। তাই দ্রুত বর্ধনশীল এই শহরকে কার্যকরভাবে গতিশীল করার জন্য নির্মাণযোগ্য জমি, উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবার অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু চাহিদার প্রয়োজনে এবং শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে নগরায়ন ঘটেই চলেছে তার আপন গতিতে। নগরায়নের এই তীব্র গতিকে একটি পরিকল্পনার আওতায় আনতে না পারলে চট্টগ্রামের বর্তমান নাগরিক সমস্যাসমূহ যেমন- যানজট, জলাবদ্ধতা, পাহাড়-ধস, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা তো যাবেই না বরং এই সমস্যাগুলো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। আশার কথা, ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ চট্টগ্রামের এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। প্রত্যাশা রইল, তাদের যথাযথ এবং সমন্বিত প্রচেষ্টায় অচিরেই এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বর্তমান সরকার চট্টগ্রামসহ এর আশপাশে অনেক মেগা-প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে এগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চট্টগ্রাম মহানগর। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও চলমান। কাজেই আগামীতে চট্টগ্রামের গুরুত্ব দেশের অর্থনীতিতে আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। আগামীর নগর চাহিদাকে সামনে রেখে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়ে তুলতে সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এখনই।

দ্রুত নগরায়নের ফলে চট্টগ্রামে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাসস্থানের চাহিদা। বর্তমানে প্রতি বছর চট্টগ্রামে নতুন প্রায় ২০ হাজার ইউনিট বাসস্থান প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে বাসস্থানের সরবরাহ নেই বললেই চলে। যতটুকু জোগান আছে, তা মূলত বেসরকারি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তাও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ অত্যন্ত কম। প্রতি বছর রিহ্যাব নিবন্ধিত ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো কমবেশি প্রায় ১০০০ এপার্টমেন্ট হস্তান্তর করে থাকে। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো অনেক বেশি ভবন হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু বাসস্থানের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম। তাই রিয়েল এস্টেট শিল্পের বিকাশেও চট্টগ্রাম অনেক সম্ভাবনাময়। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়তে প্রয়োজন পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা।

বাসস্থান মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা, একই সাথে পরিকল্পিত, উন্নত এবং বিশ্বমানের নগর তৈরিতে অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বাসস্থানসহ পরিকল্পিত ও উন্নত নগরব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে মূল শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে, ঘটাতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ। তাই চট্টগ্রাম শহরের আশপাশের এলাকাগুলোকে যেমন- আনোয়ারা, পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, সীতাকু-সহ অন্যান্য এলাকাকে আধুনিকায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব এলাকায় পরিকল্পিত উপশহর তৈরি করতে হবে। যেখানে থাকবে উন্নত আবাসন, কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং সেইসাথে কর্মসংস্থান, উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা ব্যবস্থা। আধুনিক নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে পারলে স্থানীয়দের যেমন মূল শহরে আসার প্রয়োজনীয়তা কমবে, একইসাথে চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীগণ এইসব উপশহরগুলোতে বসবাসে আগ্রহী হবে।

 

বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে বর্তমান শহর থেকে আধুনিক উপশহরগুলোতে বসবাসে উৎসাহী করতে হবে, যেমন-কর সুবিধা, বিনিয়োগ সুবিধা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে, মূল শহরের সাথে দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কমিউটার ট্রেন, মেট্রোরেল, বাস রেপিড ট্রানজিট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে স্থাপনের মাধ্যমে শহরগুলোকে সংযুক্ত করতে হবে। নগর পরিকল্পনার ভাষায় এই ধরনের আধুনিক, পরিকল্পিত উপশহরকে বলা হয় ‘গ্রোথ সেন্টার’। ১৯৯৫ সালের চট্টগ্রাম মহানগর মাস্টারপ্ল্যান ও ২০০৮ সালের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-তে হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা ও পটিয়াকে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছিল। নগরে জনসংখ্যার চাপ কমাতে এবং শহরকে পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ করতে এসব গ্রোথ সেন্টারের গুরুত্ব রয়েছে। এখন চট্টগ্রামের আশপাশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

 

এতে এই নগরের উপর জনসংখ্যার চাপ আরো বাড়বে। তাই এখনই আশপাশের এলাকাগুলোকে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে, বর্তমান শহরকে পুনঃউন্নয়ন করতে যে খরচ ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে, তার চেয়ে কম খরচে এবং সহজে এর আশপাশের এলাকাগুলোকে উন্নয়ন করা সম্ভব। যেহেতু আশপাশের এলাকাগুলোতে এখনো জনসংখ্যার ঘনত্ব কম এবং জমির মূল্যও তুলনামূলকভাবে কম, তাই এ সকল এলাকা আধুনিকায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মহানগরীকে ঢেলে সাজানো সম্ভব। চট্টগ্রামবাসীর জীবন-মান উন্নয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহের কার্যকর নেতৃত্ব প্রদানের পাশাপাশি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিযুক্ত করা যেতে পারে।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম গড়তে গ্রহণ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মহানগরী মাস্টার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫)। এই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে ইতোমধ্যে নগরজীবন আরো উন্নত হতে পারতো। তবে আশার কথা হচ্ছে নতুন করে চট্টগ্রাম মহানগরী মাস্টার প্ল্যান (২০২০-২০৪১) গ্রহণ করা হয়েছে।

আশা করি, বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত সমীক্ষার মাধ্যমে নগরের সমস্যা এবং সমাধান বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রস্তাবনা করা হবে। সেইসাথে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান চাহিদাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। নগরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দিয়ে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রকল্প গ্রহণ করলে আগামীতে নগরের বাসস্থান সরবরাহ আরো বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি নগরে বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং চট্টগ্রামের সকল সম্ভাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন হবে।

 

লেখক- প্রকৌশলী, এমডি এন্ড সিইও, সিপিডিএল

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট