চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘বিষমুক্ত’ সবজি বিপ্লবে সুদিন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:২৫ অপরাহ্ণ

আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ জরফ আলী। বিদেশ থেকে ফিরে এসে কয়েক বছর আগে শুরু করেছিলেন সবজি চাষ। তাও আবার ‘বিষমুক্ত’ নিরাপদ সবজি উৎপাদন। জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করে কম খরচে ভালো ফলন পান। পরীক্ষামূলক চাষেই সফলতা। তাঁর স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। তার দেখাদেখি এখন অন্তত অর্ধশতাধিক কৃষক বিষমুক্ত সবজি চাষ করেছেন।

জরফ আলী জানান, ‘বিদেশে ফরমালিনমুক্ত সবজি ও ফলমূলে অভ্যস্ত হয়েছি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা করে ব্যবসায়ীরা ফরমালিনমুক্ত সবজি ও ফল বিক্রি করেন। সেই সূত্র ধরে প্রবাস থেকে ফিরে ফরমালিন বা বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু করেছি। দেখাদেখিতে আশপাশের কৃষকেরাও এখন বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন। এটা ইতিবাচক। একদিন নিরাপদ সবজি চাষেও বিপ্লব ঘটবে।’

কৃষি বিভাগ জানায়, আনোয়ারার পথ ধরে বিভিন্ন উপজেলায় অর্গানিক সবজি আবাদ শুরু হয়েছে। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে নিরাপদ সবজি আবাদের ক্ষেত্র বেড়েই চলেছে। কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে বাজেটেও কৃষি উন্নয়নে বড় বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, নিরাপদ খাদ্য উপহার’ স্লোগানে এনএফএলসিসি প্রকল্প শুরু করেছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে বিষমুক্ত সবজি চাষে ব্যাপক উদ্বুদ্ধকরণ শুরু করেছে সরকার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান পূর্বকোণকে বলেন, ‘অর্গানিক সবজি উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনামূলক কর্মসূচি নিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষি অধিদপ্তরের প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে এখন বাণিজ্যিকভাবে অর্গানিক সবজি উৎপাদন বাড়ছে। জৈব কৃষি পদ্ধতি, জৈব সার, জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন সবজি উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। সেই সাফল্য ধরে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে সারাদেশে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে সকল মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর সবজি উৎপাদন। এ নিয়ে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, আনোয়ারা উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ‘বিষমুক্ত’ সবজি উৎপাদনের বীজ রোপণ হয়েছিল। এখন আনোয়ারার পথ ধরে বিভিন্ন উপজেলায় অর্গানিক সবজির আবাদ বাড়ছে। তবে সবজিতে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেড়ে গেলে আবার কেউ কেউ জৈব সারের সঙ্গে রাসায়নিক সারও ব্যবহার করছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- ভেজালের ভিড়ে এখন বিষমুক্ত সবজি, ফলমূলের চাহিদা বাড়ছে। সেই চাহিদার যোগান দিতে কৃষকরাও অর্গানিক সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে ২৮ হাজার ৯২২ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৮২৪ মে. টন। এরমধ্যে সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় বড় আকারে সবজি চাষ হয়। সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৫ হাজার তিনশ হেক্টর জমিতে সবজি রোপণ করা হয়েছে। উৎপাদন এক লাখ ২৪ হাজার ৮ শ’ টন।

সীতাকুণ্ড উপজেলা কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র নাথ পূর্বকোণকে বলেন, ‘উপজেলার চার ইউনিয়নে ১০ হেক্টর জমিতে অর্গানিক সবজির চাষ হয়েছে। ২০১৫ সালে সীমিত আকারে অর্গানিক সবজির আবাদ শুরু হয়েছে। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি, ফলনের গুণগতমান ও দীর্ঘমেয়াদি ফসল উৎপাদনে সফলতা আসায় কৃষকদের মধ্যে অর্গানিক পদ্ধতির চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে।

পথ দেখাল আনোয়ারা

আনোয়ারা উপজেলার বটতলী গ্রামের মো. জরফ আলী নিজ উদ্যোগে অর্গানিক সবজির আবাদ শুরু করেন। ছোট পরিসরে শুরু করা চাষাবাদের ক্ষেত্র এখন বড় আকার ধারণ করেছে। মো. আলীর দেখাদেখিতে এখন ৫২ জন কৃষক বাণিজ্যিকভাবে অর্গানিক সবজির আবাদ করছেন। কম খরচে ভালো ফলন পাওয়ায় আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা। মানুষের মধ্যে নিরাপদ সবজির চাহিদায় বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকদের মাঝেও অর্গানিক সবজি চাষে প্রভাব ফেলেছে। রাসায়নিক  সার ও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বিষমুক্ত সবজির চাষ প্রতি মৌসুমে বাড়ছেই।

আমাদের আনোয়ারা সংবাদদাতা আনোয়ারুল হক জানান, আনোয়ারা উপজেলায় চলতি মৌসুমে এক হাজার ৪২২ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি-ফসলের চাষ করা হয়। এরমধ্যে শিম, টমেটো, বেগুন, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, ডাল, তরমুজ, খিরা ও বাঙ্গির চাষ বেশি হয়েছে। বরুমছড়া ইউনিয়নের বাগমারার চর, রাস্তার মাথা, চাতুরী ইউনিয়নের কৈনপুরা, বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর, গুয়াপঞ্চক, হাইলধর ইউনিয়নের মালঘর, ফকিরার চর, বারখাইন ইউনিয়নের সাঙ্গু নদীর পাড়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, পাতাকপি, ব্রোকলি, মরিচ, ধনিয়া, ক্যাপসিকাম, টমেটো, শসা, খিরা, বেগুন, শিম, কাকরোল, করলা, লাউ, শাকসহ বিভিন্ন সবজি এবং তরমুজ, বাঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের চাষ করা হয়েছে। চাষাবাদে ফসলের রোগ, পোকা দমনে ক্ষতিকর বালাইনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদ ও জৈব বালাইনাশক-স্পিনোসাড, ট্রাইকো লিচেট, ডাইনামিক্স, সয়েল রিচার্জার, ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট। ‘সর্জন পদ্ধতি’ অবলম্বন করে প্রায় ২৫ হেক্টর জমিতে সবজি ও ফল চাষ হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, নিরাপদ সবজির চাষাবাদের  লক্ষ্যে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ, মনিটরিং ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়।

ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ১৫০ জন কৃষক ৬৭ একর জমিতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করেছেন। উৎপাদিত নিরাপদ সবজি বিক্রির জন্য উপজেলায় তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কাফকো হাউজিং গেট, চাতুরী বাজার থেকে এই নিরাপদ সবজি বিক্রয় করা হবে।

কৈনপুরা বাসিন্দা কৃষক উত্তম দাশ জানান, ‘উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতায় সবজি চাষে সাফল্য পেয়েছি। এতে আর্থিকভাবেও লাভবান হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়ছে।’

উপজেলা উপ-সহকারী উদ্ভিদ কর্মকর্তা সরওয়ার আলম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার ছিল মানুষের কাছে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছানো। তারই লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় সহযোগিতায় আনোয়ারা উপজেলা কৃষি অফিস নিরাপদ সবজি চাষে কৃষকদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ছে। স্থানীয় কৃষক নেপাল দত্ত, প্রদীপ দত্ত, কংস দত্ত ও তুষার দত্ত জানান, অর্গানিক সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন তারা।

চন্দনাইশ সংবাদদাতা দেলোয়ার হোসেন জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজিভা-ার খ্যাত শঙ্খ নদীর তীরে কয়েক বছর ধরে অর্গানিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। চন্দনাইশে ২ হাজার ৪৫ হেক্টর সবজি চাষের মধ্যে ৫০ হেক্টর জমিতে অর্গানিক সবজির চাষাবাদ করা হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেন, ‘নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষক উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। কীটনাশক বা সার ব্যবহার না করেই সবজি ও ফল উৎপাদন বাড়ছে। চট্টগ্রাম নগরীতে চন্দনাইশের অর্গানিক সবজি বিক্রি করা হয়।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট