চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র

হতাশ সিয়ামের বাবা-মা’র চোখে আশার আলো

রাঙ্গুনিয়া

জিগারুল ইসলাম জিগার■ রাঙ্গুনিয়া

২১ জুন, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পূর্ব সৈয়দবাড়ি এলাকার প্রবাসী মনছুর আলম ও আনজু আক্তারের একমাত্র সন্তান সিয়াম। পুরা নাম আশফাকুল আলম সিয়াম। পরিবারের সবার আদরের সিয়ামের বয়স দুই বছর পার হলেও হাঁটতে ও কথা বলতে পারতো না। সেরিব্রালপালসি রোগের শিকার ছেলেটির শারীরিক বিকাশ হচ্ছিল ধীর গতিতে। সে কখনো হাঁটতে পারবে কিংবা দাঁড়াতে পারবে বা কথা বলতে পারবে সেই আশা ছেড়ে দিয়ে ছিল এই দম্পতি। একদিন তাকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে রাঙ্গুনিয়ার প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেয়ার পরামর্শ দেন। সিয়ামকে রাঙ্গুনিয়ার প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্রে আনা হলে চিকিৎসক তাকে নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি তাকে প্যাসিভ স্ট্রেচিং, ম্যানুয়েল রেজিস্ট্রেড এক্সারসাইজ, আইসোমেট্রিক ট্রেইনিং, গেইট ট্রেইনিংসহ নানা ফিজিওথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। এভাবে চিকিৎসার কয়ে কমাসের মধ্যে তার হাত ও পায়ের মাসেলে শক্তি বাড়তে থাকে, স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে মুখের জড়তা কাটিয়ে কথা বলাও শিখে গেছে সে। সহায় কউপকরণের সাহায্যে সিয়ামএখন নিজে নিজে হাঁটতে পারে। এভাবে হতাশ সিয়ামের বাবা-মার চোখে আশার আলো জাগতে শুরু করে আদরের পুত্রকে নিয়ে।
শুধু শিশু সিয়াম নয়, সব প্রতিবন্ধী মানুষই সেবা পাচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে। এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে সহায়ক উপকরণ বিতরণ, অটিজম বিষয়ক সেবা, কাউন্সিলিং, থেরাপি (ফিজিও, অকুপেশনাল ও স্পিচএন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ) ও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়।
সিয়ামের মতো অন্য এক শিশু বিবিমরিয়ম। তাকে যখন প্রথম প্রতিবন্ধী হাসপাতালে আনা হলো তখন তার বয়স ছিল এক বছর। তখন সে বেশি ক্ষণ ঘাড় সোজা রাখতে পারতো না। কয়েক সেকেন্ড পরপর ঘাড় এলিয়ে পড়তো মায়ের কাঁধে। পা’টাও ছিল বাঁকা, চোখেও ছিল নানা সমস্যা। মা ছেনোয়ারা বেগম (৩০) জানান, ‘জন্মের পর থেকে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিলনা। জন্মের সময় মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে সে নিউরো ডেভেলপমেন্টালডিজ অর্ডারে ভুগছিল বলে ডাক্তার জানিয়েছে। দীর্ঘ দুইবছর নিয়মিতচিকিৎসার পর মরিয়ম এখন নিজে নিজে বসতে পারে, মাথা ও ঘাড় সোজাকরে দাঁড়াতে পারে। মা-বাবা বলে ডাকতে পারে। এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে ডাক্তারদের চেষ্টায়।’
কেন্দ্রের চিকিৎসক (কনসালট্যান্টফিজিও থেরাপি) মামুন হোসাই নবলেন, ‘ভালো সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। রোগী আর স্বজনদের মুখে হাসি দেখলে আমাদেরও ভালো লাগে।’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পৌর সভার ভবানী গেটের উত্তর পাশে মধ্যম নোয়াগাঁও ওয়ার্ডে এটি চালু হয় ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রাম জেলায় স্থাপিত দুটি কেন্দ্রেরমধ্যে এটিএকটি। অন্যটিনগরের হালি শহরে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কেন্দ্রে রোগীর ভিড়। রাঙ্গুনিয়া ছাড়াও পাশের উপজেলা রাউজান, বোয়ালখালী থেকেও এসেছেন প্রতিবন্ধী রোগীরা। দায়িত্বরতরা জানালেন, শুধু আশপাশের উপজেলানয় এমনকী পার্বত্য অঞ্চলের কাপ্তাই, বেতবুনিয়া, রাজস্থলী থেকেও এখানে রোগীআসে। সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্তএ খানে চিকিৎসা দেয়া হয়।
এই কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা পক্ষাঘাতগ্রস্ত মো. সোলায়মান (৪০) বলেন, ‘সংসারে আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। হঠাৎ স্ট্রোক করে শরীরের বাম পাশ অবশ হয়ে যায় এবং কথা বলতেও অসুবিধা হয়। পরে প্রতিবন্ধীহাসপাতালে এসে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি নিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছি।’
রোকেয়া আক্তার নামে রোগীর এক স্বজন বলেন, ‘আমার বাড়ি পাশেই ইছাখালী। আমার শিশুর প্রতিবন্ধী সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছি। এখানকার সেবার মান খুবই ভাল। কোন টাকা-পয়সা নেয়া হয় না। শুধ মাত্র ভর্তির সময় জাতীয়পরিচয় পত্র ও একটি ছবি নিয়েছিল। এখানে এসে ডাক্তারদের ব্যবহারে রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে।’
কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চালুর পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৩৮৪৯ জন, সেবা গ্রহীতার সংখ্যা ৬৫ হাজার ১৪৯ জন। এই পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে সহায়ক উপকরণ হুইল চেয়ার ২৫১ টি, ট্রাইসাইকেল ৬টি, সাদাছড়ি ৩২টি, হিয়ারিং এইড ৭টি, ক্রাচ ৭টি, স্ট্যান্ডিং ফ্রেম ৮টি, ওয়াকিং ফ্রেম ৫টি ও কর্নার চেয়ার ৭টি বিতরণ করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী বিষয় ককর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুনবলেন, ‘প্রতিদিন ৬০-৭০ জন রোগী আসে যারা গড়ে ১০০ টি সেবা নিয়ে থাকেন। এই কেন্দ্রে যেসব সেবা দেয়া হয় তাহলো- স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, ফ্রোজেন সোল্ডার, জিবিএস, এনকাইলোজিং স্পন্ডালাইটিস, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, মোবাইল থেরাপিভ্যান সার্ভিস, বাত-ব্যথা (কোমর/মাজা-ঘাড়-মেরুদ-ে বা হাঁটুতে), স্পন্ডালাইটিস, আর্থ্রাইটিস (অস্টিও/রিমাটয়েড), স্পোর্টস ও আঘাতজনিত সমস্যা, সেরিব্রালপলসি ও প্রতিবন্ধিতা, কাউন্সিলিং ও প্রশিক্ষণ সুবিধা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এই প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রটি চট্টগ্রামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। এই কেন্দ্রটিতে সেবা নিতে কোন চিকিৎসা ফি দিতে হয় না। এই কেন্দ্রে রোগীদের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সর্বোচ্চ সেবা দেয়া হয়।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট