চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আয়ুষ্কালের খড়গ শুধু ট্যাক্সিতে!

নাজিম মুহাম্মদ 

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:২১ অপরাহ্ণ

মেয়াদকাল পার হয়ে যাওয়ায় তিন হাজারেরও বেশি সিএনজিচালিত ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। বলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব নগরী গড়তে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনামতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মেয়াদের ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে।

ত্রিচক্র যান ট্যাক্সির বয়সকাল ১৫ বছর বিবেচনা করা হলেও নগরীতে চলাচলরত অন্য কোন যানবাহনের বয়সের কোন সময়সীমা নেই। কোন ধরনের মেয়াদকাল ছাড়া নগরীতে লক্কর ঝক্কর বাস মিনিবাস চলছে বছরের পর বছর ধরে। অনেক বাসের নেই নম্বর প্লেট, গায়ের ছাল-বাকল উঠে গেছে সেই কবে। বাসের কালো ধোঁয়ায় প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে নগর পরিবেশ। বন্দরে পণ্য আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রাকগুলোর বয়স এত বেশি হয়েছে তৈরি সন খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তাও সন্দেহ রয়েছে। কোনটির বয়স পঞ্চাশ আবার কোনটির বয়স আরো বেশি। কিছু ট্রাকের নেই দরজা আবার কিছু ট্রাকের দরজা ও সামনের গ্লাস কিছুরই অস্তিত্ত নেই। প্রশ্ন উঠেছে ট্যাক্সির বয়সকাল ১৫ বছর নির্ধারণ করা-১৫ বছর হতে না হতেই প্রতিযোগিতা দিয়ে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যতই না বেশি আগ্রহ বড় যানবাহনের ক্ষেত্রে মেয়াদকালের ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ নেই ? প্রশ্ন উঠেছে পরিবেশ নষ্টের জন্য শুধুই কি ট্যাক্সিই দায়ী?

২৫ বছর বয়সী বাস: আরটিসির (রোড ট্রান্সপোর্ট কমিটি) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন এলাকায় ১৬টি রুটে ১০৪০টি বাস-মিনিবাস, ১৮ রুটে ৯৯৪টি হিউম্যান হলার ও ২১ রুটে ১৮৩৯টি অটেটেম্পো চলাচল করছে। ২০১৮ সালের আরটিসির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো, ২০ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে এমন টেম্পো, হিউম্যান হলার কিংবা ২৫ বছরের বেশি অতিবাহিত হয়েছে এমন বাস মিনিবাস নগরী থেকে বের করে দেয়া হবে। বাস্তবতা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া এসব গাড়িগুলো ঠিকই বছরের পর বছর চলাচল করছে নগরীতে।

পরিবহন নেতাদের বক্তব্য : নাম প্রকাশে না করার শর্তে ট্যাক্সি সংগঠনের একজন নেতা বলেন, ক্ষমতাবানরা সবসময় পার পেয়ে যায় সহজে। বড়দের দোষ কম দেখে সবাই। পরিবেশ কিংবা যানজট সবকিছুর জন্য ট্যাক্সিই যেন দায়ী। ছোটরা সবসময় হয়রানি হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে।

মেট্টোপলিটন পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, আরটিসির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ বছরের বেশি বয়স কালের হিউম্যান হলার ও ২৫ বেশি বয়স কালের বাস মিনিবাস নগরীর বাইরে সরিয়ে নেয়ার কথা। সিএনজি  ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করা হলেও অর্থনৈতিক বিষয়টি চিন্তা করে বাস মিনিবাসের বেলায় তা করা হচ্ছেনা। ২৫ বছর মেয়াদ পার হয়েছে এমন বাস মিনিবাস বিআরটিএ নতুন করে রুট পারমিট দিচ্ছেনা। কিন্তু  ট্রাফিক বিভাগকে ম্যানেজ করে রুট পারমিটবিহীন এসব যানবাহন নগরীতে অহরহ চলছে। বিশেষ করে কাঠগড়, বহদ্দারহাট এলাকায় এ ধরনের যানবাহন সবচেয়ে বেশি।

সড়কে যানবাহন দেখভাল করার প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগ দোষ দিচ্ছে একে অপরের। আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থার (ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান) সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহম্মদ বলেন, বন্দর থেকে পণ্য আনা নেয়ার কাজে আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত যেসব  ট্রাক কাভার্ডভ্যান রয়েছে সবই নতুন মডেলের। সবগুলো গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ রয়েছে। তবে বন্দর থেকে নগরীর অভ্যন্তরে মালমাল আনা নেয়ার কাজে বন্দর ট্রাক কাভার্ডভ্যান কন্ট্রাকটর এসোসিয়েশনের আওতাধীন প্রায় তিন হাজার ট্রাক রয়েছে। যেসব গাড়ির বয়সকাল অর্ধশত বছরের কাছাকাছি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এসব ট্রাক চলছে। এসব গাড়ির অধিকাংশের  হালনাগাদ কাগজপত্র নেই। গত ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বন্দরের সভায় বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছিলো।

বন্দর কভার্ডভ্যান মালিক ও কন্ট্রাকটর এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হাজি জহুর আহমদ ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চেয়েছেন। বিষয়টি জানতে গতকাল জহুর আহমদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ট্রাফিক বিভাগের বক্তব্য : নগর ট্রাফিকের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোখলেসুর রহমান জানান, সড়কে চলাচলরত যানবাহনের কাগজপত্র দেখার কাজটি করে ট্রাফিক বিভাগ। রোড পারমিট, চালকের লাইসেন্স কিংবা ফিটনেস সার্টিফিকেটসহ আনুসঙ্গিক কাগজপত্র থাকলে কোন যানবাহনকে আইনগতভাবে আটকানোর সুযোগ থাকে না।

২০ বছরের বেশি বয়স হয়েছে এমন হিউম্যান হলার ও ২৫ বছরের বেশি বয়স হয়েছে এমন বাস মিনিবাস নগরীতে থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে আরটিসির সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ডিসি মোখলেস বলেন, ওই বিষয়টিও দেখভাল করার দায়িত্ব বিআরটিএ’র। গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলে  ট্রাফিক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না।

বিআরটি’র বক্তব্য : জানতে চাইলে, বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৫ বছর বয়স পার হয়েছে এমন সিএনজি ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে। বড় যানবাহনের ব্যাপারে এ ধরনের কোন নির্দেশনা নেই।

বিআরটিএ কর্মকর্তা তৌহিদুল জানান, বড় যানবাহন ধ্বংস করার ক্ষেত্রে মানুষের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়। ২০/২৫ বছর পার হলে ওই যানবাহনকে নতুন করে পারমিট দেয়া হচ্ছেনা। নগরীর বাইরে পাঠানো হচ্ছে। তবে সিএনজি স্ক্র্যাপ করা শুরু হলে বাস মিনিবাসের মলিকরা মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া গাড়ি স্ক্র্যাপ করার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে। তারা এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১৩ হাজার করে মোট ২৬ হাজার সিএনজি ট্যাক্সি নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। এসব গাড়ির মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ বছর। বলা হচ্ছে পরিবেশগত ক্ষতির প্রভাবমুক্ত হতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইতিমধ্যে ঢাকায় নিবন্ধিত ১৩ হাজার ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ মডেলে প্রস্তুুতকৃত এমন সাড়ে আট হাজার ট্যাক্সি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিস্থাপন করা হয়। করোনায় মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে পুনরায় ট্যাক্সি স্ক্র্যাপ করার কাজ শুরু করে বিআরটিএ। এ দফায় তিন হাজার ৯৪৪টি স্ক্র্যাপ করার সিন্ধান্ত নিয়েছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট