চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কক্সবাজার কারাগারে ইয়াবা কারবারিদের দৌরাত্ম্য

কারা সুপার বজলুরসহ কয়েকজনের সম্পদ অনুসন্ধানের সুপারিশ দুদকের

আরাফাতুল মজিদ, কক্সবাজার

২০ জুন, ২০১৯ | ১:১১ অপরাহ্ণ

এবার দুদকের জালে আটকা পড়ছেন ‘সোনার হরিণ’ হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার জেলার কারা তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রশিদ আখন্দ।

কক্সবাজার জেলা কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্ত, বদলিসহ নানা প্রশাসনিক পদক্ষেপ ঠেকিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন দুর্নীতির এই বরপুত্র। অভ্যন্তরীণ এসব প্রশাসনিক পদক্ষেপ ধামাচাপা দিলেও শেষপর্যন্ত দুদকের জালে আটকা পড়তে হয়েছে তাকে।

গত ১৬ জুন কক্সবাজার জেলা কারাগারে হানা দেন দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির ও উপসহকারী পরিচালক মো. রিয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বিশেষ দল। অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক প্রমাণ পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের ওই দলটি ইতিমধ্যেই কারা তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রশিদ আখন্দ, জেলার ও কয়েকজন ডেপুটি জেলার এবং কারারক্ষীর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে। এছাড়া কি কি অনিয়ম-দুর্নীতি পাওয়া গেছে তার একটি প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনটি শিগগিরই কমিশনে উত্থাপন করা হবে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

উপসহকারী পরিচালক মো. রিয়াজউদ্দিন পূর্বকোণ অনলাইনকে বলেন, ‘দুদকের অভিযানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে বেশুমার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেটা প্রতিবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ ই-মেইলযোগে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে কয়েক কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ রয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নানা অভিযোগের পরও কক্সবাজার জেলা কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে বহাল তবিয়তে থেকে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন কারা তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রশিদ আখন্দসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কারারক্ষী। এর মধ্যে বজলুর রশিদ ঢাকায় বাড়ি করেছেন। তিনি কক্সবাজার থেকে কাঠ নিয়ে বাড়ির দরজা ও আসবাবপত্র তৈরী করেছেন। এছাড়া বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদেরও মালিক হয়েছেন। নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। কক্সবাজার কারাগারে র্দীঘদিন থাকার সুবাদে তার সাথে দেশের কোটিপতি সব ইয়াবা ডনের গভীর সখ্যতা তৈরী হয়। এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বদৌলতেই বেড়ে যায় তার সম্পদের পাহাড়।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কারাগারের ৩ নম্বর সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডকে ঘিরে সবসময় কারারক্ষীদের ভিড় লেগেই থাকে। কারা কর্মকর্তাদের আনাগোনাও বেশি এই ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের বন্দিরা সবাই যেন ‘ভিআইপি’। তারা মোবাইল ফোনে কথা বলেন। গরুর মাংস, মুরগি ও বড় মাছ দিয়ে রাজসিক খাবার পরিবেশন করা হয় তাদের। ওয়ার্ডের দেয়াল ও ফ্লোরে ঝকঝকে নতুন টাইলস লাগানো হয়েছে। ওয়ার্ডের প্রত্যেক বন্দি ৫০ হাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে এসব সুযোগ নিচ্ছেন। আর প্রতিদিনের জন্য বাড়তি অর্থ তো আছেই। এখানকার বন্দিরা আর কেউ নন, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে আত্মসমর্পণ করা কোটিপতি ইয়াবা কারবারি তারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির চার ভাই আবদুস শুক্কুর, আমিনুর রহমান, মো. ফয়সাল রহমান ও শফিকুল ইসলাম। পাশাপাশি আছেন আরো একাধিক কোটিপতি ইয়াবা কারবারি। শুধু তাই নয়, পুরো কারাগারই এখন ইয়াবা কারবারিদের স্বর্গরাজ্য। জেলার ইয়াবা কারবারি ছাড়াও সারা দেশের বড় ইয়াবা কারবারিরা তদবির করে এ কারাগারে চালান হয়ে আসেন। এই কারাগারের ৪ হাজার ৩৮৮ জন বন্দির মধ্যে ৭০ শতাংশই ইয়াবা কারবারি। কারারক্ষীরা ইয়াবা কারবারিদের টার্গেট করে অর্থ আদায় করেন। আর এতে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন সাধারণ বন্দিরা। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বদির কয়েকজন স্বজনসহ আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন ইয়াবা কারবারিকে কক্সবাজার কারাগারে রাখা হয়েছে। তাদের কারণে অন্য বন্দিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাসোহারা দিয়ে কারা হাসপাতালের বেডগুলোর প্রায় সবকটিই ইয়াবা কারবারিরা দখল করে রেখেছেন। কেউ পরিদর্শনে গেলে দ্রুত তাদের সরিয়ে সেখানে কয়েকজন অসুস্থ ও পাগল-প্রকৃতির লোক এনে রাখা হয়।

দুদকের অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন, ‘আমার কারাগারে ৫৩০ জন ধারণক্ষমতার মধ্যে বন্দি আছে ৪ হাজার ৩৮৮ জন। যাদের ৭০ শতাংশই ইয়াবা কারবারি। তাদের সেলে না রাখলে আমি কোথায় রাখব? ইয়াবা কারবারি বলে তো আমি তাদের ক্রসফায়ারে দিতে পারি না, তাদের ওয়ার্ডেই রাখতে হবে।’

পূর্বকোণ/ময়মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট