চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনার টিকা: এলো আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

ইমাম হোসাইন রাজু 

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে করোনার সংক্রমণ শনাক্তের বছর পার হতে এখনও দুই মাস বাকি। অজ্ঞাত এ সংক্রমণ নিয়ে গেল দশ মাস এ অঞ্চলের মানুষ যুদ্ধ করলেও অবশেষে মুক্তির পথ যেন হাতছানি দিয়েছে। আজ রবিবার থেকে নগরীর দুই হাসপাতালসহ ১৬ হাসপাতালে শুরু হবে টিকাদান কার্যক্রম। ইতোমধ্যে এসব হাসপাতালে টিকা কার্যক্রমের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম দিনে এ ১৬ হাসপাতালের পাঁচশ’ জনের শরীরে টিকা প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এরমধ্যে সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। একই সাথে টিকাও গ্রহণ করবেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে তাতেও এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এ দুই হাসপাতালে প্রথমদিন ১৪০ জনকে টিকার আওতায় আনা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও একই সঙ্গে শুরু হবে টিকা কার্যক্রম। প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে ২০ জন করে টিকা গ্রহণ করবেন। চমেক ও জেনারেল হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় এক সঙ্গে টিকা দেয়া শুরু হবে। ইতোমধ্যে প্রতি কেন্দ্রের জন্য ভ্যাকসিনও পৌঁছানো হয়েছে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অন্য কেন্দ্রে ও বুথেও শুরু হবে এ কার্যক্রম। প্রথমে সম্মুখসারির যারা আছেন, তাদের টিকার আওতায় আনা হবে। পরবর্তীতে সকলকেই টিকা দেয়া হবে।

কেন্দ্রের সংখ্যা

প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সর্বমোট ১৫টি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে চলবে টিকাদান কার্যক্রম। এছাড়া ১৪ উপজেলায় সর্বমোট ২১৬টি কেন্দ্রে দেয়া হবে করোনার এ ভ্যাকসিন। নগরী ও উপজেলায় সর্বমোট ২৩১ কেন্দ্রে কার্যক্রম চলবে টিকাদানের।

 

টিম সংখ্যা ও সদস্য কত

 

নগরীর ১৫টি টিকাদান কেন্দ্রে ৬৫টি টিম টিকাদানের কার্যক্রম চালাবে। প্রতিটি টিমের সদস্য সংখ্যা ৬। সে হিসেবে নগরীতে সর্বমোট ৩৯০ জন থাকবেন টিকার সহায়তায়।  এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ২৪১টি টিমে কাজ করবেন সর্বমোট ১ হাজার ৪৩৬ জন। নগরী ও উপজেলা নিয়ে সর্বমোট ৩০৬ জনের টিমে ১ হাজার ৮২৬ জন সদস্য কাজ করবেন টিকাদান সহায়তায়।

নগরীর ১৫ কেন্দ্র

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইউএসটিসি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চসিকের বন্দরটিলা হাসপাতাল, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চসিক মোস্তফা হাকিম মাতৃসদন হাসপাতাল,  চসিক সাফা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতাল, চট্টগ্রাম পুলিশ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচ, নৌবাহিনী হাসপাতাল এবং বিমানবাহিনী হাসপাতাল।

টিকাদান চলবে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা

আজ রবিবার নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। পরে তা পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কেন্দ্রে দেয়া হবে। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। টিকাদান কেন্দ্রগুলো দু’জন চিকিৎসক তত্ত্বাবধান করবেন। একই সাথে টিকা গ্রহীতা আসার পর তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হবে।

আজ যারা টিকা নেবেন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সকালে প্রথম শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া টিকা নিবেন। এছাড়া তালিকায় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রী আয়েশা সুলতানা, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মুমিনুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে তালিকায়।

ভ্যাকসিন বা টিকা কী?

টিকা মানুষের দেহকে নির্দিষ্ট কোনো একটি সংক্রমণ, ভাইরাস কিংবা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত করে। টিকায় মূলত যে বস্তুটির কারণে ওই রোগটি হয় তার একটি নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল অংশ থাকে যাকে ‘ব্লু-প্রিন্ট’ বলা হয়। এই অংশটি দেহে একই রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পরবর্তীতে ওই ভাইরাসের আক্রমণ শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং সেটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে কোন টিকা দেয়া হচ্ছে?

ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা কোভিশিল্ড দেয়া হবে। ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে এই টিকাটি আনা হয়েছে। সিরাম ইন্সটিটিউট এই টিকাটি উৎপাদনে এস্ট্রাজেনেকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

কারা প্রথম টিকা পাবেন

টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে ১৭টি ক্যাটাগরির নাগরিকদের নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেন সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মী, বেসরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মী, প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকল সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা, সম্মুখ সারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ধর্মীয় প্রতিনিধি, সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, নৌ-রেল-বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তি, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সরকারি কার্যালয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক।

একবার টিকা নিলে কতদিন সুরক্ষিত থাকা যাবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো টিকাই শতভাগ নিরাপত্তা দিতে পারে না। আর একবার টিকা নিলে কতদিন সুরক্ষা মিলবে সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আর তাই এখনো পরামর্শ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, টিকা নিলেও যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়।

যাদের টিকা দেয়া হবে না

রেজিস্ট্রেশনকৃত/লাইন লিস্টিং-এর অর্ন্তভুক্ত তালিকার উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে কোভিড-১৯ টিকা দেয়া হবে না।

এছাড়া ১৮ বছরের নিচে, গর্ভবতী মা এবং দুগ্ধদানকারী মা, অসুস্থ ও হাসপাতালে ভর্তিকৃত ব্যক্তি, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে টিকা দেয়া হবে না।

তবে অসুস্থ ও হাসপাতালে ভর্তিকৃত ব্যক্তিদের পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্র থেকে টিকা নিতে অনুরোধ করতে হবে। এছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার ২৮ দিন পর টিকা নিতে পারবেন।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?

এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন একটা নিরাপদ ভ্যাকসিন। তবে ভ্যাকসিন নেয়ার পরে কারো কারো ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন ভ্যাকসিন প্রয়োগের জায়গা ফুলে যাওয়া, সামান্য জ্বর হওয়া, বমি বমি ভাব, মাথা ও শরীর ব্যথা। যা স্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এতে আতংকের কিছুই নেই।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বিনামূল্যের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর টিকা গ্রহণকারী কারো মধ্যে যদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

টিকা নেয়ার পর কী করতে হবে?

টিকা নেয়ার পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং সেগুলো দুই একদিন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন নেয়ার পর টিকা কেন্দ্রে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। ভ্যাকসিন নেয়ার পর যেকোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে নির্ধারিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র/স্বাস্থ্যকর্মী/চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করুন। ভ্যাকসিন নেয়ার পরেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবন যাপন করুন।

কেন টিকা নেবেন

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দেয় এই টিকা। সেই সাথে অন্যকে সুরক্ষিত রাখতেও সহায়তা করে। এই টিকাকে মহামারী থেকে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া টিকাদান কর্মসূচি কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কোভিডের সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেবে এবং হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের পথ তৈরি করবে। এটা আমরা যত দ্রুত অর্জন করতে পারবো তত দ্রুত আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো। এমনই মতামত জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়া ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেনন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম।

এ দুই বিশেষজ্ঞের মতে, একটা দেশের ৭০ শতাংশ জনগণ যদি টিকার আওতায় চলে আসে, তাহলে এ রোগ খুব সহজেই প্রতিরোধ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে কোন ধরণের মেডিসিনের প্রয়োজন হয় না। একই সাথে টিকা নিয়ে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পারবো। এখন পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছে তাদের মধ্যে কোন ধরণের পাশ^প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। স্বাভাবিক কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তাই সকলের টিকা নেয়া উচিত। কোনো ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকলে সবাইকেই এই টিকা নিতে উৎসাহিত করছেন এ দুই চিকিৎসক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট