চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দুর্ভোগে বোয়ালখালী-পটিয়ার দুই লক্ষ মানুষ

নদীর পাড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট

অনুমোদন না নিয়ে গভীর নলকূপ স্থাপন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২০ জুন, ২০১৯ | ২:১২ পূর্বাহ্ণ

পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়ন। পশ্চিমে কর্ণফুলী, উত্তর বোয়ালখালী ও দক্ষিণে শিকলবাহা খাল। তিন দিকে নদী-খালবেস্টিত এলাকা হওয়া বর্ষাকালে পানিতে থৈ থৈ করে। ডুবে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও পুকুর-ডোবা-জলাশয়। নদী-খাল তীরবর্তী এই এলাকায় পানিতে থৈ থৈ করলেও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একই অবস্থা হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নেও। দুই ইউনিয়নে লক্ষাধিক মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। এজন্য নদী তীরে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাকে দুষছে এলাকাবাসী ও জনস্বাস্থ্য বিভাগ। শুধু পটিয়ার কোলাগাঁও বা হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন নয়, বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদ-ী ও শাকপুরা ইউনিয়নেও সুপেয় পানি তীব্র সংকট দীর্ঘদিনের। এই দুটি ইউনিয়নও কর্ণফুলী নদী, বোয়ালখালী ও রায়খালী খালবেস্টিত। এখানে বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকে নিম্নাঞ্চল। তারপরও দুই ইউনিয়নে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছেন। এলাকাবাসীর জানায়, খরস্রােতা কর্ণফুলী নদী ও নদী সংলগ্ন বোয়ালখালী, রায়খালী, শিকলবাহা খালকে ঘিরে ঘিরে গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় অন্তত অর্ধ শতাধিক শিল্প-কারখানা। কারখানাগুলোতে বড় ব্যাসের একাধিক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এসব নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ থেকে পানি তোলার কারণে জনবসতি এলাকার নলকূপগুলোতে আর পানি পাওয়া যায় না।
কোন প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বড় ব্যাসের গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে শিল্প মালিকেরা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান একাধিক নলকূপও স্থাপন করেছে। এজন্য এলাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অথচ ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা অর্ডিন্যান্স-১৯৮৫ এ উল্লেখ রয়েছে পাশ্ববর্তী এলাকায় কোন বিরূপ বা ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি না করলেই কোন নলকূপ বা গভীর নলকূপ স্থাপনের বিধান করা হয়েছে। অর্ডিন্যান্সের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, উপজেলা বা থানা পরিষদের লাইসেন্স বা গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ছাড়া গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা যাবে।
অনুমোদনের বিষয়ে কথা হয় পটিয়া, বোয়ালখালী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগ, পৌর মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তারা জানালেন, কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই শিল্প কারখানা মালিকেরা মর্জিমাফিক গভীর নলকূল স্থাপন করেছে। যার প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যের উপর।
পটিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী উত্তম কুমার মজুমদার পূর্বকোণকে বলেন, ‘গভীর নলকূপ স্থাপন করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন ছাড়াই শিল্প-কারখানায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এজন্য কোলাগাঁও, হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকার সরকারি নলকূলগুলো অকেজো হয়ে গেছে। এজন্য মানুষ খাবার পানির তীব্র সংকটে রয়েছে। এজন্য সরকার ও স্থানীয় সাংসদ সামশুল হক চৌধুরীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করে সংকট কিছুটা দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগ জানায়, সরকারি নিয়ম হচ্ছে দেড় বাই তিন ইঞ্চি ব্যাসের নলকূপ বসানোর। কিন্তু শিল্প-কারখানায় ৪ বাই ৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হয়েছে। এসব কারণে পটিয়ার কোলাগাঁও, হাবিলাস ও আশপাশের এলাকায় পানির স্তর ৪০-৪৫ ফুট নিচে নেমে গেছে বলে জানায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগ। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনবসতি এলাকায়।
বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ এর ২ উপ ধারায় সুপেয় পানি অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবং ১৯ ধারায় ভূ-গর্ভস্থ পানি আহরণে বিধি নিষেধ উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার বিভাগ যৌথভাবে সার্ভে করে আসল কারণ নির্ণয় করতে সহায়ক হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর কোলাগাঁও ইউনিয়নের বোয়ালখালী খাল থেকে শিকলবাহ খাল পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। নতুনভাবে বসানো হয়েছে আরও চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়াও রয়েছে জাহাজ নির্মাণ কারখানা এবং শিকলবাহা কালারপুল এলাকায় রয়েছে গার্মেন্টস, ডায়িং কারখানা। প্রতিটি কারখানায় একাধিক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এতে এলাকা কয়েকশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসীর নাওয়া, ধোঁয়া-মুছা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পুকুর বা জলাশয়ের পানির উপর নির্ভর করতে হয়। আর খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে। ভ্যানে করে খাবার পানির কলসি নিয়ে যেতে দেখা যায়।
কোলাগাঁও এলাকার বাসিন্দা ব্যাংকার জাহাঙ্গীর আলম ও আশফাক শাহজাহান বলেন, কোলাগাঁও উত্তর পাড়ায় সরকারিভাবে তিনটি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দারা সকাল-বিকেল দুই পালায় খাবার পানি সংগ্রহ করেন। আর গোসল ও ধোঁয়া-মোছার জন্য পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয়। তারা বলেন, ঘন জনবসতি এলাকায় আটটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। পানির সংকট ছাড়াও পরিবেশ দূষণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে রয়েছে।
শিকলবাহ খালের কালারপুল সংলগ্ন মোহাম্মদনগর এলাকায় এক বছর ধরে সুপেয় পানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য এলাকাবাসী অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। গত রমজানেও বিক্ষোভ করেছিল এলাকাবাসী। এলাকার বাসিন্দা কলিম উল্লাহ, রেজা মিয়া জানান, এলাকায় প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস, ডায়িং ও জাহাজ নির্মাণ কারখানায় বড় ব্যাসের একাধিক গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। এসব কারণে এলাকার নলকূপগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। লক্ষাধিক টাকা খরচ করে গভীর নলকূল বসানোর মতো সক্ষম এলাকাবাসীর নেই। এলাকাবাসীর আন্দোলনের কারণে একটি গার্মেন্টস ও ডায়িং কারখানার পক্ষ থেকে পাইপের মাধ্যমে এলাকার অন্তত ১৫ স্থানে খাবার পানি বিতরণে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত রমজানে সরবরাহ করা পানি ছিল পানের অযোগ্য। আন্দোলন করেও সুফল পায়নি এলাকাবাসী।
পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ এলাকায় সুপেয় পানি সমস্যা দীর্ঘদিনের। ইউনিয়নের চরকানাই, হাবিলাসদ্বীপ, পাঁচরিয়া, হুলাইন এলাকায় গড়ে ওঠেছে গার্মেন্টস, ডায়িং, নিটিং, পেপার মিল, মিনারেল ওয়াটার কারখানা, লবণ মিল। দেড় কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১০টি ভারী শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছে।
২০১৬ সালে হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নে ভূ-গর্ভস্থ পানির বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ ও জনগণের পানির অধিকার নিয়ে এক গণশুনানি করে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। শুনানিতে প্রতিবেদন পাঠ করেছিলেন এডভোকেট মুজিবুর রহমান খান। এতে বলা হয়েছে, চার গ্রামে ৪০ হাজার মানুষের বসবাস এলাকায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। এসব কারণে এলাকার তিন শতাধিক নলকূল অকেজো হয়ে পড়েছে।
এই বিষয়ে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার পক্ষ থেকে শিল্প মালিক, পটিয়ার ইউএনও, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
পটিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী উত্তম কুমার মজুমদার বলেন, মামলার পর কয়েকটি কারখানার গভীর নলকূল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ইউনিয়নের ৫০ হাজার মানুষ খাবার পানির তীর সংকটে রয়েছে। বিষয়টি উপজেলা সমন্বয় সভায় একাধিকবার উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সুরাহা করা যাচ্ছে না।
পটিয়া ছাড়াও বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদ-ী, শাকপুরা এলাকার সংকট দীর্ঘদিনের। কালুরঘাট চরখিদিরপুর এলাকায় পেপার মিল, গার্মেন্টস ও ডায়িং মিল স্থাপনের পর থেকে ওই এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়। বতর্মানে চরখিজিরপুর, রায়খালী ঘাটকুল, বানু মেম্বার টেক, গোলদারপাড়া, বশির মেম্বার বাড়ি এলাকা এবং শাকপুরার ১ নং ওয়ার্ড, ৫ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম পাড়া, উত্তর ও দক্ষিণ পাড়া, কাজিবাড়ি এলাকায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
বোয়ালখালী পৌর মেয়র হাজি আবুল কালাম আবু জানান, চেয়ারম্যান থাকা অবস্থা থেকে ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি। কোন সুফল পাচ্ছি না। আমার ঘরে পর্যন্ত পানি সংকট রয়েছে। ২০১৪ সালের পর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলাকায় অন্তত দুইশ টিউটওয়েল স্থাপন করেছি। সবগুলো এখন অকেজো হয়ে পড়েছে।
পশ্চিম গোমদ-ী বানু মেম্বার এলাকার বাসিন্দা মো. সেলিম ও ইদ্রিস আলী জানান, নদী বা খালের পানি ব্যবহার না করে শিল্প কারখানাগুলোতে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে বোতলজাত করা হচ্ছে। আর এলাকার মানুষ পানি পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে গভীর এক থেকে এক লাখ ২০ হাজার খরচ করে গভীর নলকূপ বসাতে হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য নেই তারা দূর দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট