চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হালদায় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ

হালদা নদী: বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ নাকি পানি উত্তোলন প্রকল্প ?

মোহাম্মদ আলী 

৩০ জানুয়ারি, ২০২১ | ২:২৮ অপরাহ্ণ

হালদা থেকে পানি উত্তোলন নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির পর এবার নদীর পাড়ে সভা করছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)।

‘হালদা নদী বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা আজ (শনিবার) বেলা দেড়টায় হাটহাজারীর সাত্তারঘাট এলাকায় অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। সভা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে হালদা থেকে দৈনিক ১৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দিতে একটি নতুন প্রকল্প তৈরি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এ নিয়ে পরিবেশগত একটি সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য জমা দেয় আইডব্লিউএম। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সভায় প্রণীত সমীক্ষা রিপোর্ট নিয়ে নানা অসঙ্গতির বির্তক সৃষ্টি হয়। একই সাথে সমীক্ষা রিপোর্টটি পুনরায় রিভিউ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেওয়া হয়।

হালদা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রিপোর্ট দেওয়ার আগে হালদা নদীর ইকোলজিক্যাল ফ্লো নির্ধারণ, নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা, ডলফিনের বিচরণ এবং রুই জাতীয় মাছের প্রজননের জন্য কি পরিমাণ পানি প্রয়োজন সেটি নির্ধারণ করা দরকার ছিল। এরপর অতিরিক্ত পানি থাকলে তা উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া ২০১৬ সালে প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম হালদা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালায়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ওই গবেষণায় হালদায় পানি সংকট উল্লেখ করে বলা হয়, ভুজপুর রাবারড্যাম, হালদার বিভিন্ন শাখা খালের মুখে স্থাপিত ১৬টি স্লুইসগেট ও প্যারালাল খাল প্রজেক্টের কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব স্থাপনার কারণে হালদার পানির স্রোত আটকে যাচ্ছে। তাই এগুলো অপসারণ করে পানি ফ্লো বৃদ্ধির জন্য রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়। তাছাড়া অতীতে ১১টি বাঁক কেটে দেওয়ার কারণে হালদার দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার কমে গেছে। আগে নদীর দৈর্ঘ্য ছিল ১২৩ কিলোমিটার। বর্তমানে আছে ৯৮ কিলোমিটার। এ কারণে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে।

এছাড়াও চট্টগ্রাম ওয়াসার মোহরা ও মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে হালদা থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কারণে শুষ্ক  মৌসুমে নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে থাকে। তাই নতুন কোন প্রকল্প গ্রহণ করলে এসব বিষয় মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ টিমের এসব সুপারিশ এড়িয়ে গিয়ে হালদা থেকে দৈনিক আরো ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে ওয়াসার প্রস্তাবিত প্রকল্পের পক্ষে গত সেপ্টেম্বরে রিপোর্ট দেয় আইডব্লিউএম। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিতে গেলে আইডব্লিউএম’র রিপোর্টের বিষয়ে বিভিন্ন ত্রুটি উঠে আসে।

আইডব্লিউএম এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, ফেব্রুয়ারি মাসে হালদাতে প্রতি সেকেন্ডে পানির ফ্লো থাকে ৩১৭ দশমিক ২ কিউবিক মিটার। নভেম্বর মাসে থাকে ৩৮৪ দশমিক ৭ কিউবিক মিটার। সারা বছর হালদা নদীতে পানির যে ফ্লো থাকে তা থেকে মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হবে। সুতরাং এ নিয়ে নদীর জীববৈচিত্র এবং মাছের কোন ক্ষতি হবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হালদা থেকে মোহরা ও মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে দৈনিক ১৮ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের পরও চাহিদা মেটাতে রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকায় কর্ণফুলী নদী থেকে দৈনিক আরো ১৪ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে ওয়াসা। এরমধ্যে মিরসরাইয়ে বাস্তবায়নাধীন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীর পানির প্রয়োজন হলে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করছে ওয়াসা। এটির দৈনিক উৎপাদন হবে ১৪ কোটি লিটার। মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প স্থাপনার পাশে এ প্রকল্পটি তৈরি হবে। প্রকল্পের উৎপাদিত পানি প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বর্তমান ১৮ কোটি লিটারের সাথে নতুন প্রকল্পের আরো ১৪ কোটি লিটার যোগ হলে হালদা থেকে দৈনিক পানি উৎপাদন হবে ৩২ কোটি লিটার। বিপুল এ পানি উত্তোলন হলে হালদার মৎস্য প্রজনন, জীববৈচিত্র্য এবং মোহরা ও মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হ্যারিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত পানি উত্তোলন হলে হালদা বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার ফারহানা লাভলী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘নানা কারণে হালদার পানির স্রোত অনেক কমে গেছে। সুতরাং হালদা থেকে নতুন করে পানি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এটির বিকল্প খোঁজতে হবে। কারণ হালদাকে বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে নতুন করে পানি উত্তোলন হলে হালদার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে’।

ফারহানা লাভলী অভিযোগ করে বলেন, ‘আইডব্লিউএম’র রিপোর্ট প্রণয়নের আগে মাঠ পর্যায়ে কোন কাজ হয়নি। এমনকি আমাদের সাথেও কথা হয়নি। এটি প্রণয়নের আগে হালদা সংশ্লিষ্ট লোকজনের মতামত নেওয়া উচিত ছিল’।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘প্রকল্পের জন্য পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়ার আগে আইডব্লিউএম’র রিপোর্ট নিয়ে হালদা সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেছি। তাদের মতামতের ভিত্তিতে আইডব্লিউএম’র রিপোর্ট সংশোধন করতে বলেছি’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীর জন্য পানির চাহিদা পূরণে হালদার পরিবর্তে বিকল্প উৎস খোঁজতে হবে’।

তিনি বলেন, ‘আইডব্লিউএম’র রিপোর্ট কোন বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ভিত্তিতে নয়, তথ্যগত যথেষ্ট মিথ্যাচার করার মাধ্যমে পানি উত্তোলনের যুক্তি দেখানো হয়েছে। রিপোর্টে কোন তথ্যগত ডাটা এবং পরিমাপের পদ্ধতিগত অস্তিত্ব নেই। আইডব্লিওএম’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী হালদা থেকে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ভাটায় মোহরায় পানির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৬০০-২১৫০ এমএলডি, যার গড় পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮৭৫ এমএলডি।

একই সময় নদী থেকে ওয়াসার দৈনিক পানির চাহিদা ৫৬১ এমএলডি, অথচ যার সহজ ঐকিক নিয়মে নদী থেকে মোট পানি উত্তোলনের পরিমাণ হয় প্রায় ২৯.৯২%। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসকে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রজননের পূর্ববর্তী মাস বা প্রি স্পনিং টাইম বলে। এসময় মাছের গোনাডের পরিপক্কতা ও বৃদ্ধির জন্য নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গুণগত মানসম্পন্ন পানি এবং প্রচুর পরিমাণ খাদ্যের (প্লাংটন ও মাইক্রো বেনথিক অর্গানিজম) প্রয়োজন হয়। যদি সেই সময়ে নদীর পানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ (২৯.৯২%) তুলে ফেলা হয় তাহলে পানি স্বল্পতা এবং লবণাক্ততার কারণে হালদায় রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র, অন্যান্য মাছ, ডলফিনসহ সব জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সাথে কর্ণফুলী নদীর লবণাক্ত পানি হালদা নদীতে অনুপ্রবেশের কারণে চট্টগ্রাম শহরের মানুষের দৈনন্দিন পানির চাহিদা হুমকির সম্মুখীন হবে’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট