চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চসিক নির্বাচন: প্রশ্ন অনেক, মিলছে না উত্তর

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও মরিয়ম জাহান মুন্নী 

৩০ জানুয়ারি, ২০২১ | ১:৩৪ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে প্রায় এক শতাংশ। এই নৈরাশ্যজনক চিত্রের মধ্যেও কিছু কেন্দ্রে আকাশ ছোঁয়া ভোট পড়েছে। সর্বোচ্চ ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। ভোটের চিত্র যাই হোক, অতীতের সকল নির্বাচনের চেয়ে কম ভোট পড়েছে এবার চসিক নির্বাচনে। ভোটের হার ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যায়নি।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। সেই নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ভোটকেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের অভিযোগে সকাল ১০টার পরই ভোট বর্জন করেছিলেন বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম। তারপরও তিন লাখ চার হাজার ৮৩৭ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। আর বিজয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীন পেয়েছিলেন চার লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট।

গত সিটি নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটের হার ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় এক শতাংশ। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভোটের হার ছিল ২৭ শতাংশ। সেখানেও প্রায় ৭৩ শতাংশ ভোটার ভোট দেননি।

বিশ্লেষকদের দাবি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। মেয়র ও কাউন্সিলরদের মানুষ কাছাকাছি পায়। তৃণমূলে কাজ করেন কাউন্সিলররা। তাই ভোটে কাউন্সিলরদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর অংশগ্রহণ বেশি থাকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। নির্বাচনী প্রচারণায় থাকে উৎসবমুখর। ভোটদানেও মানুষের আগ্রহ থাকে। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে মানুষের মধ্যে ভোটের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ২০১৮ সাল থেকে তা আরও অবনমন হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়ে পড়েছে। মানুষ ভাবেন, ভোট দিলেও যা হবে না দিলেও তা হবে। অর্থাৎ ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত মনে করেন ভোটাররা। ভোটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। তাই মানুষ ভোটকেন্দ্র আসতে চাই না।’

ভোটের ফলাফল ঘোষণায় সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ইভিএমে দ্রুত সময়ে ফলাফল ঘোষণার কথা ছিল। সেখানে ১০ ঘণ্টা লাগল কেন। কাগজের ব্যালেটেও এত সময় লাগার কথা নয়। এতে ফলাফল নিয়ে সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনিয়ম-বৈষম্য জনসম্মুখে রয়ে গেল।’

নির্বাচনব্যবস্থা এখন গভীর খাদে পড়েছে। তা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও প্রকট রূপ নেবে।

বিশ্লেষকেরা জানান, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের এজেন্ট বের করে দেওয়া, গণ-গ্রেপ্তার, মামলা-হামলার কারণে ঘরছাড়া ছিল। এছাড়াও ইভিএম মেশিনে ভোটাররা আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট প্যানেল খোলার পর ভোট নিশ্চিত করেছেন অবাঞ্ছিত লোক। সরকারি দলের লোকজন ভোটের গোপন কক্ষে পাহারা দিয়ে ভোট নিশ্চিত করে নিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন ভোটাররা। গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় ভোটের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন তারা। নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ভোটের গুরুত্ব হারাচ্ছে ভোটারের কাছে। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে ভোটারদের অনাগ্রহকে গণতন্ত্রের  জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে বিশাল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী।

নির্বাচনের দিন দৈনিক পূর্বকোণের ১৫ জন সাংবাদিক বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ভোটের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেছেন। এতে দেখা যায়, অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। সকাল ১১ ও ১২টার পরও বিভিন্ন কেন্দ্রে হাতেগোনা ভোট পড়েছে। চান্দগাঁও, মোহরা, পাঁচলাইশ এলাকায় দেখা যায়, সকালে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের খরা ছিল। তবে কেন্দ্রের বাইরে শত শত লোকের ভিড় ছিল। বহিরাগত লোকজনের কড়া পাহারায় ছিল ভোটকেন্দ্র। সবই ছিল একটি দলের অনুসারী। এই দৃশ্য নগরীর প্রতিটি কেন্দ্রেই দেখা গিয়েছিল। এছাড়াও ভোটদানের গোপন কক্ষে অবাঞ্ছিত লোকের উপস্থিতি ছিল। ইভিএমের ব্যালট প্যানেল ভোট নিশ্চিত করে নিয়েছেন এই অবাঞ্ছিত লোকেরা। বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর ধানের শীষের এজেন্ট উপস্থিত ছিল না। এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল বিএনপির।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক থেকে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪ কেন্দ্রে। ১০-২০ শতাংশ ভোট পড়েছে ২৩১ কেন্দ্রে। ২০-৩০ শতাশ ভোট পড়েছে ১৬০ কেন্দ্রে। ৩০-৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫২ কেন্দ্রে। ৪০-৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে ২৬ কেন্দ্রে। ৫০-৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫৫ কেন্দ্রে। ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৫ কেন্দ্রে।

দেখা যায়, সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে হালিশহর আহমদ মিয়া সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ভোটার সংখ্যা ৩০৮২ ভোট। ভোট পড়েছে ৪২টি। ভোটের হার এক দশমিক ৩৬ শতাংশ। দক্ষিণ-মধ্য হালিশহরের দরবেশীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (২য় তলা) কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩৩০৫। ভোট পড়েছে ৫৯ টি। ভোটের হার এক দশমিক ৭৯ শতাংশ।

পূর্ব বাকলিয়া সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ও কলেজ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৩৬৫। ভোট পড়েছে ৪২ টি। ভোটের হার এক দশমিক ৭৮ শতাংশ। আল জামেয়া আল আরাবীয়া মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসা ভোটের হার এক দশমিক ৭৮ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ইপিজেড দক্ষিণ হালিশহর  এহয়াউল উলুম আরবিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে (নতুন ভবন)। ভোটার সংখ্যা ৩১০৮। এ কেন্দ্রে ভোটের হার ৯৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। রামপুর ঈদগাহ বড় পুকুর পাড় চিটাগাং লিবার্টি স্কুল এন্ড কলেজ (তয় তলা) কেন্দ্রে ভোটের হার ৯০ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট