চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল

সবই অবৈধ সিটি ক্লিনিকের, রিফাতের মৃত্যু অনুমানের অপারেশনে

নাজিম মুহাম্মদ

২১ জানুয়ারি, ২০২১ | ৪:৪২ অপরাহ্ণ

অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে অনুমানের উপর দুই বার অপারেশন করা হয় ২৫ বছরের রিফাত সুলতানার। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তার। চকবাজারের আলোচিত সিটি হেলথ নামের যে ক্লিনিকে রিফাতকে অপারেশন করা হয়েছিলো সেই ক্লিনিকের সব কিছুই অবৈধ।

চকবাজার পুলিশ সম্প্রতি আদালতে রিফাতের মৃত্যু সংক্রান্ত যে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল করেছে তাতে এমনই মন্তব্য করেছে পুলিশ। গর্ভপাতের উদ্দেশ্যে গত বছরের ১৪ মে সিটি হেলথে ভর্তি হওয়ার পরদিন অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে মারা যান রিফাত। তার প্রায় ৭ মাস পর এ চার্জশিট দাখিল করা হয়।

চার পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একটিমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে চকবাজারের মতো ব্যস্ত এলাকায় বছরের পর বছর ধরে অবৈধ ক্লিনিকের ব্যবসা করছিলো চান্দগাঁও এলাকার হারুন অর রশিদ। সেখানে কর্মরত নার্সদেরও ছিলো না কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। মাত্র দশ হাজার টাকার লোভে অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে নিহত রিফাত করোনায় মারা গেছেন বলে জানিয়েছে ক্লিনিকের মালিক হারুন।

গত বছরের ১৫ মে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মারা যায় রিফাত। ঘটনার দশদিনের মাথায় মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন রিফাতের বাবা খোকন মিয়াজী। মামলার পর পরই ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া সিভিল সার্জন। গ্রেপ্তার করা হয় ক্লিনিক মালিকসহ পাঁচজনকে। রিফাত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ।

চকবাজার থানার পরিদর্শক (ওসি) রুহুল আমিন জানান, রিফাত হত্যায় পাঁচজনের সম্পৃক্ত থাকার বিষয় তদন্তে উঠে এসেছে। আমরা পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে বিজ্ঞ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি। পাঁচজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামীরা হলেন,ডবলমুরিং থানার উমদা মিয়া সওদাগর বাড়ির মো. আবুল বাসারের ছেলে আবুল কালাম মো. সেজান (২৭), সিটি হেলথ ক্লিনিকের মালিক চান্দগাঁও গোলাম আলি নাজির বাড়ির মৃত হানিফ চৌধুরীর ছেলে হারুন অর রশিদ (৬০), ক্লিনিকের নার্স বাঁশখালীর বাণীগ্রামের লিটন দাশের স্ত্রী অলকা পাল (৩২), বাকলিয়া ফুলতলার গান্ধী দাসের স্ত্রী গীতা দাস (৪৫), ও ফটিকছড়ির আলি সরকার বাড়ির মৃত মো. রফিকের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন চম্পা (৪৩)

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীর ডবলমুরিং থানার আবুল বাসারের ছেলে আবুল কালাম মো. সেজানের সাথে নিহত রিফাতের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। অন্তসত্ত্বা হলে গর্ভপাত ঘটাতে তাকে চকবাজার মোড়ে সিটি হেলথ ক্লিনিকে নিয়ে যায় সেজান। ক্লিনিক মালিক হারুন অর রশিদ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে গত ১৪ মে ক্লিনিকে ভর্তি করায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া কথিত নার্স সাবিনা ইয়াসমিন চম্পা, অলকা পাল ও গীতা দাশ রিফাতের অপারেশন করে। তিনজনের কারো নার্সিং বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তারা সেজানকে জানায় অপারেশন সফল হয়েছে। অপারেশন পরবর্তী রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে ক্লিনিক মালিক হারুনের আদেশে রিফাতকে দ্বিতীয়বার অপারেশন করায়। এ বিষয়টি তারা গোপন করেন। পরদিন দুপুরে রিফাতের মৃত্যু সংবাদ দেয়া ক্লিনিক মালিক হারুন। মূলত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পরদিন (১৫ মে ) রিফাত মারা যায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলেও করোনায় মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে স্বজনদের রিফাতের লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয়। দাফনের আগে গোসল করাতে গিয়ে মাথার পিছনে থেঁতলানো ও পিঠের নীচে কোমরে উপরে একধিক আঘাতের চিহ্ন দেখে স্বজনের মনে হয়েছে রিফাতের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। করোনায় মৃত্যু হয়েছে এমনটি বলার কারণে লোকজনের অনুরোধে তখন লাশটি দাফন করা হয়। ১৭ মে মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে নগরীর চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন মেয়েটির বাবা খোকন মিয়াজী। গত বছরের ১০ জুন বিজ্ঞ আদালতের আদেশে রিফাতের মৃতদেহ কবর থেকে তোলে ময়নাতদন্ত করা হয়। গত ১১ নভেম্বর সিটি হেলথ ক্লিনিকে অভিযান চালায় জেলা সিভিল সার্জন।

পরে দেখা যায়, কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে চলছিলো ক্লিনিকটি। যে তিনজন নার্স রিফাতের অপারেশন করেছে তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। ক্লিনিক মালিক নিজেই অনুমানের উপর কথিত নার্স দিয়ে জটিল অপারেশন করাতো। বিশেষ করে অবৈধ গর্ভপাতের কাজটি বেশী করা হতো সেখানে। অবৈধ গর্ভপাত ঘটাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রিফাত মারা গেলেও করেনায়কালিন সময়ে করোনায় মারা যাবার কথা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো হারুন।

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট