চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আদালতে নজিরবিহীন জালিয়াতি

মোস্তফা মোহাম্মদ এমরান  

১৭ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:৩৭ অপরাহ্ণ

হাটহাজারীর প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১২ একর সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন দুই মামলার নথি গায়েব করে তার স্থলে ভুয়া আরজি ঢুকিয়ে দেয়ার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালে দায়ের করা অর্পিত সম্পত্তির দুটি মামলার আরজি গায়েব করে জাল আরজি ঢুকিয়ে দেয়ার এ ঘটনায় আদালতের কতিপয় কর্মচারী, সরকারি পদবীর সাথে একাধিক পেশা পরিচয়দানকারী এক আইনজীবীসহ বড় ধরনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জাল-জালিয়াতি করতে ২০১২ সালের দুটি মামলায় দুইটি আদালতের ফাইলিং রেজিস্ট্রার, আরজি, আদালতের আদেশও বদলে ফেলেছে ওই চক্র। এ জালিয়াতি ধরা পড়ার পর মামলা দুটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

প্রকৃত আরজি গায়েব করে মূল বাদির স্থলে একটি মামলার বাদি সেজেছেন হাটহাজারী চন্দ্রপুরের মরহুম ইয়াহিয়া চৌধুরীর ছেলে মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী ও অন্যটিতে বাদি সেজেছেন একই থানার আলমপুরের মরহুম আবিদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ জেবল হোসেন।

আদালতসূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৩১ জুলাই হাটহাজারী আলীপুরের পল্লীশ্রী এলাকার মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল হক জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাটহাজারীর ফটিকার ১০ শতক অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য (ভিপি মামলা) ৬৯৭/২০১২ মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার আরজি গায়েব করে নুরুল হকের স্থলে রেজিস্ট্রারে এয়াছিন চৌধুরীর নাম বাদি হিসেবে সংযুক্ত করা হয়। জাল আরজিতে তফসিল দেখানো হয় হাটহাজারীর মধ্য পাহাড়তলী মৌজার ১১ একর ৯১ শতক জমি। অপরদিকে, একই তারিখে সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য একই আদালতে মামলা (ভিপি মামলা নম্বর -৮৩৬/২০১২) দায়ের করেন জনৈক বসির উদ্দিন। পরে বসির উদ্দিনের স্থলে জালিয়াতির মাধ্যমে মোহাম্মদ জেবল হোসেনের নাম ঢুকানো হয়। ভুয়া আরজির তফসিলে পাহাড়তলী  মৌজার ১৬  শতক ভূমি দেখানো হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই মামলার মূল বাদি নুরুল হক ও বসির আহমেদ মামলা দায়েরের ৩ বছর পর থেকে মামলাগুলোর খবরাখবর রাখেননি। নিযুক্ত আইনজীবী ২০১৭ পর্যন্ত মামলা দুটো নিজ গরজে পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে মূল বাদি যোগাযোগ রক্ষা না করায় নিযুক্ত আইনজীবী ২০১৭ সাল থেকে মামলা দুটো আর পরিচালনা করেননি। এই সুযোগে ২০১৮ সালে জালিয়াতচক্রের সহায়তায় এয়াছিন ও জেবল নামের দুই ব্যক্তি আদালতের ২০১২ সালের  মামলার ফাইলিং রেজিস্ট্রারে মূলবাদির নাম মুছে দিয়ে নিজেদের নাম বাদি হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন।

ওই মামলা দুটো ২০১৩ ও ২০১৪ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ ট্রাইবুনাল (জেলা ও দায়রা জজ আদালত) থেকে তৃতীয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বিচার নিষ্পত্তির জন্য স্থানান্তরিত হয়। জালিয়াতচক্র মামলার নম্বর অপরিবর্তিত রেখে ওই আদালতের নথি গায়েব করে এ আরজিগুলো ঢুকিয়ে দেয়। দুটি মামলাতে মূল মামলার বাদির হাজিরা, দরখাস্তসহ সব ধরনের দলিলপত্র গায়েব করে নিজেদের দলিলপত্র ঢুকিয়ে দেয়। দুটি মামলার জাল আরজির বাদি দুইজন পৃথক ব্যক্তি হলেও তারা একই স্বার্থে যৌথভাবে সরকারি ১২ একর ৭ শতক ভূমি আত্মসাতের জন্য এ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে একাধিক আইনজীবী মনে করছেন।

মামলার নথি থেকে মূল মামলার আইনজীবীর ওকালতনামা সরিয়ে ২০১৮ সালের ওকালতনামাকে ২০১২ সালের ওকালতনামা হিসাবে দেখানো হয়। জানতে চাইলে আইনজীবী জানান, জাল মামলায় ব্যবহৃত ওকালতনামা ২০১৮ সালে সরবরাহ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের স্বাক্ষর মুছে দিয়ে সেখানে ২০১২ সালের সাংস্কৃকিত সম্পাদকের স্বাক্ষর জাল করে বসায় জালিয়াতচক্র। কিন্তু  ওকালতনামার সিরিয়াল নম্বর ২০১৮ সালের।

জানা যায়, হাটহাজারীর মধ্য পাহাড়তলীর প্রতি শতক ভিটেভূমির সরকারি মৌজামূল্য ২ লাখ ৩৮ হাজার ২৬০ টাকা সে হিসেবে ১২ একর ৭ শতক ভূমির মূল্য ২৮ কোটি ৭৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮২০ টাকা।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি মৌজামূল্যের প্রায় ৪ গুণ মূল্যে মধ্য পাহাড়তলীর ভূমি ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে। এ ব্যাপারে হাটহাজারীর সিনিয়র রেজিস্ট্রার্ড দলিল লেখক মাস্টার মো. ইউনুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মৌজার রাস্তার পার্শ^বর্তী জায়গার প্রতি শতক ভূমি ৫/৬ লাখ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গড়ে ওই ভূমির প্রতি শতকের বেসরকারি বাজারমূল্য কমপক্ষে ৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে ওই ভূমির মূল্য শত (১০০ কোটি) কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আদালতসূত্রে জানা যায়, ৬৯৭/২০১২ মামলাটির মূল বাদি ও নিকটাত্মীয় আরও  ৬ টি অবমুক্তির মামলা দায়ের করেন। ওই মামলাগুলো একই মৌজার উল্লেখ করে মামলা দুটিতে দুই ভুয়া বাদির স্বার্থ রয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইবুনালে আবেদন করেন। ১০০৬/১২ নম্বরের আরেকটি মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ আবেদন করেন এয়াছিন ও জেবল। ২০১৯ সালে এ মামলার সাথে নুরুল হক ও তার আত্মীয়ের করা ৬ টি মামলা একসাথে বিচারের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল দরখাস্ত নামঞ্জুর হলে তারা একই বিষয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন জেবল ও ইয়াছিন। ২০১২ সালে করা মামলায় ৬ বছর পর পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করার কারণেই মূলত বিচারক ও মামলার সরকারি আইনজীবী (ভিপি কৌঁসুলি)সহ আইনজীবীদের সন্দেহ হয়। মামলার আদেশেও উল্লেখ করা হয়, মামলাগুলো যদি একই সময়ে দায়ের করা হতো তাহলে মামলা দায়েরের পর পরই তারা পক্ষভুক্ত হতেন। অথবা একই সময়ে তারা এ বিষয়ে মামলা দায়ের করতেন।

জালিয়াতির বিষয়টি আদালতের নজরে আসার পর এ নিয়ে নথিগুলো পর্যালোচনা করে আদালত সিদ্ধান্তে আসেন যে, দুটি মামলার আরজি পরিবর্তন করে স্বার্থ সংশ্লিষ্টহীন ব্যক্তিরা জাল আরজি ঢুকিয়েছে।

অর্পিত সম্পত্তির মামলা দায়েরের সময় তামাদি হওয়ার অর্ধযুগ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আদালতের সাথে এ জালিয়াতি করেছে ওই চক্র। সম্প্রতি জেলা ও দায়রা জজ কার্যালয়ের এক আদেশে মামলা দুটির তদন্ত করার জন্য এক আদেশ দেয়া হয়। এদিকে, সম্প্রতি তৃতীয় সিনিয়র সহকারী জজ ও অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইবুনালের বিচারক মোছাম্মত ইসরাত জাহানের আদেশে দুটি মামলায় জালিয়াতি হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

ভিপি ৬৯৭/১২ মামলার আসল মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী মো. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, আমার মক্কেলের মামলার নথি গায়েব করে  মামলাটিতে জনৈক ইয়াছিন ভুয়া আরজি সংযুক্ত করেছেন।

এদিকে, ভুয়া আরজিতে দেয়া নাম স্বাক্ষরযুক্ত এক আইনজীবী আদালতে দরখাস্ত দিয়ে জানান, তার ওকালতনামা ও সিল স্বাক্ষর জাল করে ওই আরজিতে ঢোকানো হয়েছে। অরপদিকে, অন্য একজন আইনজীবী নাম প্রকাশ করতে এবং  এ ব্যাপারে কোনরূপ মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন।

এদিকে, ইয়াছিন ও জেবলের সাথে যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করেও তাদের ফোন নম্বর সংশ্লিষ্টদের থেকে পাওয়া যায়নি। এদিকে, সম্প্রতি জেবল হোসেনের মৃত্যু হয়েছে বলে তাঁর এক আইনজীবীর মাধ্যমে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইনজীবী জানান, ভুয়া আরজিতে আইনজীবীর সিল স্বাক্ষরও জালিয়াতি করা হয়েছে। এসব জালিয়াতির জন্য তিনি একাধারে সরকারি কর্মচারী হিসেবে পরিচয়দানকারী ও আইনজীবী সমিতিভুক্ত এক আইনজীবীসহ আদালতের কর্মচারীসহ একাধিক সিন্ডিকেট জড়িত বলে মনে করেন।

অর্পিত সম্পত্তির সরকারি আইনজীবী (ভিপি) মো. আবু হানিফ পূর্বকোণকে জানান, আমার পেশাগত জীবনে এ ধরনের জালিয়াতি দেখিনি। তাছাড়া আমাদের সিনিয়রদের মুখেও এ জঘন্য জালিয়াতির কথা শুনিনি। তিনি এ জালিয়াতিতে নজিরবিহীন উল্লেখ করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এএইচএম জিয়াউদ্দিন (জিয়া) পূর্বকোণকে বলেন, এ জালিয়াত চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে সে যত শক্তিশালীই হোক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট