চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

দেয়ালে দেয়ালে বেপরোয়া বিজ্ঞাপন, রাজস্ব বঞ্চিত চসিক

চট্টগ্রাম নগরী: বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাচ্ছে দেয়াল!

ইফতেখারুল ইসলাম

১৬ জানুয়ারি, ২০২১ | ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানের সীমানা দেয়ালে অবৈধভাবে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। যাতে মারাত্মকভাবে ‘দৃশ্যদূষণ’ ঘটছে। বিনষ্ট হচ্ছে নগরীর সৌন্দর্য। প্রচারণার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় এক দিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের সৌন্দর্য ও আমাদের রুচিজ্ঞান, অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে। দেয়াল লিখন ও পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘দৃশ্যদূষণ’ প্রতিরোধে অবৈধ দেয়াল লিখন অপসারণে অভিযান জোরালোভাবে শুরু করতে হবে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, জাকির হোসেন রোডের রেলক্রসিং থেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দিকে যে সড়কটি গেছে, তার পাশে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সীমানা দেয়ালজুড়ে চট্টগ্রামের একটি শিল্প গ্রুপের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন আঁকা হয়েছে। একইভাবে নগরীর বিভিন্ন স্থাপনার সীমানা দেয়াল, মার্কেট ও সড়ক সংলগ্ন বাস ভবনের বাইরের দেয়াল, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালসহ যেখানেই সুযোগ পেয়েছে সেখানেই বিভিন্ন পণ্য এবং প্রতিষ্ঠানের অবৈধ বিজ্ঞাপন আঁকা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) চট্টগ্রামের এডভোকেট ফারমিন এলাহী পূর্বকোণকে বলেন, ‘পরিবেশ দূষণের কথা এলেই বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব ছাড়াও আরেকটি দূষণ আছে। সেটি হলো ‘দৃশ্যদূষণ’। দৃশ্যদূষণের কারণে নান্দনিক সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়। যা একটি দৃশ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি উপভোগ করার ক্ষমতা হ্রাস করে। দৃশ্যদূষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্ষতিকারক পরিবর্তন তৈরি করে মানুষের দর্শনীয় স্থানগুলিকে বিরক্তিকর করে তুলে। চাক্ষুষ দূষণের সংস্পশের্র নেতিবাচক প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে-বিক্ষিপ্ততা, চোখের ক্লান্তি, মতামতের বৈচিত্র হ্রাস এবং পরিচয় হ্রাস। অনেক সময় দেয়াল বিজ্ঞাপন দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হয় যে, ওই প্রতিষ্ঠানকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না’।

তিনি বলেন, বন্দর নগরীর রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বড় বড় দেয়াল লিখন। রাস্তার পাশের স্থাপনাগুলোর দেয়াল, বৈদ্যুতিক খুঁটি এমনকি বড় গাছগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। এছাড়া রয়েছে বিদ্যালয়, কলেজ, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রচারণামূলক বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। আর তা দৃশ্যমান থাকে জনবহুল স্থানগুলোতে। এতে ব্যাপকভাবে দৃশ্যদূষণ হচ্ছে এবং যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে। নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্টকারী এসব উপকরণ অনেক সময় মানুষকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। রাস্তাঘাটে যানবাহনে চলার সময় দেখা যায়, বিভিন্নভাবে ভাড়া দেয়া বা ওয়েব সাইটের পোস্টার লাগানো থাকে। বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার চিত্র দেখলে মনে হয় সারাবছর ধরে চলছে বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের মহোৎসব। শহরের অলিগলি, রাস্তা-ঘাট, বাসস্থান, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, দোকান ও অন্যান্য স্থাপনার দেয়াল, এবং বৃক্ষ, বিদ্যুতের খুঁটি, সড়কদ্বীপ, সড়ক বিভাজক, ব্রিজ, কালভার্ট, যানবাহন; এমনকি বাদ যায়নি মসজিদ, মন্দিরের দেয়ালও। এদের মধ্যে বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যের কোম্পানি, কোচিং সেন্টার, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয় এর কোম্পানি রয়েছে।

এছাড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, সড়ক বাতির খুঁটি ইত্যাদিতে দেখা যায় পাত্র/পাত্রি, হারবাল ওষুধ, জমিজমা ক্রয়-বিক্রয়, কবিরাজ, কাজীর প্রচারণা, পীর-ফকির, দরবেশের বিজ্ঞাপন, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, টু-লেট, কোচিং সেন্টার, স্কুল, কলেজ ভর্তিসহ নানান ধরনের বিজ্ঞাপন। নব নির্মিত ভবনের সন্মুখে দেখা যায় স্টিল কিংবা সিমেন্ট কোম্পানির বিলবোর্ড। এই শহর যেন বিজ্ঞাপনের এক ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে।

আইন যা আছে : দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণকল্পে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ নামে একটি আইন পাস করে।

আইনের ধারা -৪ এ বলা হয়েছে যেকোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং ওই নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে এর জন্য নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে।

আইনের ধারা-৩ এ বলা আছে, নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যকোন স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ।

শুধুমাত্র ধারা-৯ এর বিশেষ বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচনে, নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে। শাস্তি বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে অন্যূন পাঁচ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে অনধিক ১৫ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করা যাবে এবং সুবিধা ভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে এই অপরাধের জন্য ওই সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে অন্যূন ১০ হাজার টাকা এবং অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা অর্থ দ-, অনাদায়ে অনধিক ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করা যাবে।

ধারা-৮ এ বলা হয়েছে যেকোন কোম্পানী কর্তৃক এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটিত হলে ওই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কোম্পানির এমন প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এই অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে গণ্য হবে।

সিটি কর্পোরেশনের বক্তব্য :
চসিক’র রাজস্ব বিভাগের উপকর কর্মকর্তা এবং সাইনবোর্ডের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুপন কান্তি চৌধুরী পূর্বকোণকে জানান, চট্টগ্রাম শহরে বার্জার এর কিছু দেয়াল লিখনের অনুমতি আছে। আর কাউকে দেয়াল লিখনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশের অনুমতি দেয়া হয়নি। অবৈধভাবে কেউ দেয়াল লিখন বা চিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমরা সেখানে গিয়ে তা মুছে দিই। তাছাড়া পরিচ্ছন্নকর্মীদের নির্দেশ দেয়া আছে, যেখানেই অবৈধ দেয়াল লিখন দেখবে তা যেন সাথে সাথে মুছে দেয়।

তিনি জানান, দেয়াল লিখন বিজ্ঞাপন একটি অনালোকিত বিজ্ঞাপন। সিটি কর্পোরেশন থেকে এই বিজ্ঞাপনের অনুমতি নিতে গেলে প্রতি বর্গফুটে ১০০ টাকা রাজস্ব প্রদান করতে হয়। তিনি জানান, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলের শুরুর দিকে বিলবোর্ড উচ্ছেদ শুরু হয়। ওইসময় দেয়াল লিখনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে আর কাউকে অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে শহরের মধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় কিছু দেয়ালে কাজ করেছেন। যেমন : খাস্তগীর স্কুলের দেয়াল, সেন্ট মেরিস স্কুলের দেয়াল ইত্যাদি।

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট