চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সংবাদ বিশ্লেষণ

ট্রাম্প কীভাবে পেলেন এতো ভোট!

বিভক্ত আমেরিকা

ডা. আফতাবুজ্জামান

১৫ জানুয়ারি, ২০২১ | ৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প পেয়েছেন ৭৪ মিলিয়ন ভোট, বাইডেন পেয়েছেন ৮২ মিলিয়নের কাছাকাছি। ৭৪ মিলিয়ন অনেক ভোট, ওবামার চেয়েও বেশি। অনেকের প্রশ্ন ট্রাম্প এতো ভোট কিভাবে পান?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোয়ালিশন বলে একটা কথা আছে। কোয়ালিশন হল বিভিন্ন বড় ভোটিং ব্লকের সমর্থন আদায় করা। ট্রাম্পের কোয়ালিশনে কারা আছে?
১। ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টান।
কোন কোন হিসাব মতে আমেরিকার খ্রিস্টানদের প্রায় ৩০% ইভাঞ্জেলিকাল। এদের বেশ কিছু দাবি আছে, এরমধ্যে প্রধান হল গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা। এরা গর্ভপাতকে নরহত্যা মনে করে। এরা চায় আইন করে গর্ভপাত বন্ধ করা হোক। গত কয়েক দশকে আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট তাদের দাবিকে সিরিয়াসলি নেয়নি। ট্রাম্প তাদের সমর্থন দিয়েছে। তাই তাদের অনেকেই ভাবে ট্রাম্প ঈশ্বর প্রেরিত, শয়তানের হাত থেকে আমেরিকা এবং বিশ্বকে রক্ষা করতে ঈশ্বর ট্রাম্পকে পাঠিয়েছে। ইভাঞ্জেলিকালদের প্রায় ৮০% ট্রাম্পকে ভোট দেয়। এরা ঘোর মুসলিম বিরোধী।
২। সাদা খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদি।
এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) সাধারণ মানুষ : এরা মনে করে, সাদা খ্রিষ্টানরা আধুনিক আমেরিকার স্থপতি, তাদের হাতে এক সময় সব ক্ষমতা ছিল, তারা অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ্য ছিল, কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে যারা সাদা নয় তাদের হাতে, তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য এরা মূলত দায়ী করে হিস্প্যানিকদের। এদের পরবর্তী শত্রু হল মুসলমানরা। এরা ভাবে সুযোগ পেলে মুসলমানরা আমেরিকায় শরিয়া আইন প্রচলন করবে। এই কারণে ট্রাম্পের সীমান্ত দেয়াল ও মুসলিম ব্যান এদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।
খ) উগ্র সাদা জাতীয়তাবাদী: এরা মনে করে সাদা জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ। সাদা ছাড়া অন্য সবার বিরোধী হলেও এরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে কালো, ইহুদি ও মুসলমানদের। সংখ্যায় এরা তেমন বেশি নয়, তবে আমেরিকা জুড়ে এদের অসংখ্য সংগঠন রয়েছে। কোন রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে এদের কখনো সমর্থন করেনি। ট্রাম্প নিজেও সরাসরি করেনি, কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে করেছে, এদের জন্য এটাই যথেষ্ট।
৩। যারা আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ও বহনের পক্ষে।
আমেরিকার সংবিধান আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ও বহনের অধিকার দেয়। আমেরিকার একটা বড় অংশে আগ্নেয়াস্ত্র তাদের সংস্কৃতির অংশ। সেখানে গান লবি খুবই শক্তিশালী। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ও বহনের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে বিভিন্ন কারণে, এরা চায় নিষিদ্ধ না হলেও আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ও বহনের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হোক। ট্রাম্প এবং অন্যান্য রিপাবলিকান আগ্নেয়াস্ত্র সমর্থকদের সমর্থন আদায় করেছে এই বলে যে ডেমোক্র্যাটরা তাদের কাছ থেকে সব বন্দুক কেড়ে নেবে।
৪। সাদা শ্রমিক।
আজ থেকে প্রায় ৫০/৬০ বছর আগে আমেরিকার শ্রমিকরা ছিল মূলত সাদা, তারা ম্যানুফ্যাকচারিং জব করতো এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি ভালো অবস্থায় ছিল। ক্রমান্বয়ে এদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও একটা বড় কারণ হল বিশ্বায়ন। শত শত কারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় কয়েক দশকে এবং শ্রমিকরা বেকার হয়ে যায়। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা এদের অবহেলা করেছে বছরের পর বছর। এবারের আগের নির্বাচনে ট্রাম্প তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে নির্বাচিত হলে তারা কাজ ফিরে পাবে। যদিও ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি এবং ট্রাম্পের সময় বিলিয়নিয়ারদের পকেট ভারি হয়েছে, ট্রাম্পের প্রতি তাদের সমর্থন অক্ষুণœ আছে।
৫। এস্টাব্লিশেমেন্ট বিরোধী।
আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ মনে করে সরকার ও রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিপরায়ণ, তারা জনগণের জন্য কাজ করেনা। ট্রাম্প এর আগের নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দেয় সে নির্বাচিত হলে দুর্নীতি দূর করবে। যদিও অধিকাংশ মানুষ মনে করে ট্রাম্প নিজেই দুর্নীতিবাজ এবং তার শাসনামলে সে দুর্নীতিবাজদের সে আশ্রয় দিয়েছে, অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে।
৬। কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক। এরা কোনভাবেই দলের বাইরে ভোট দেয়না।
৭। যারা কনস্পির‌্যাসি থিওরিতে বিশ্বাস করে।
এদের অনেকেই মনে করে গুটিকয়েক মানুষ গোপনে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে যাদের মূল লক্ষ্য শয়তানের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অনেকে আবার মনে করে শাসকশ্রেুীর একটা বড় অংশ পেডোফাইল এবং এদের একটা গোপন চক্র আছে। এরা মনে করে ট্রাম্প এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ইন্টারনেটের কারণে এই থিওরিগুলো অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভোটে কারচুপি হয়েছে একথা এরা সহজেই বিশ্বাস করে।
৮। ইসরায়েল লবি।
এই লবি প্রচ- শক্তিশালী। এই কারণে গত কয়েক দশকে সব প্রেসিডেন্ট এই লবির আশীর্বাদ নিয়েছে। কিন্তু সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ট্রাম্প। এই কারণে ট্রাম্প ইসরায়েলে খুব জনপ্রিয় এবং ইসরায়েলপন্থী বড় দাতারা তাকে অর্থ সমর্থন দিয়েছে।
প্রচুর জনসমর্থন থাকলেও গত নির্বাচনে এবং তার আগের নির্বাচনে অধিকাংশ মানুষ ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এরা কারা? এরা মূলত ট্রাম্পের নীতির বা তার চরিত্রের বিরোধী।
১। এরা মনে করে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত ডাক্তারদের মতামতের উপর ভিত্তি করে মা’দের একান্ত নিজের, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কিছু বলার নেই এবং ইভাঞ্জেলিকালদের পক্ষে ট্রাম্পের সমর্থন মেয়েদের অধিকারের পরিপন্থী।
২। এরা মনে করে সাদা জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে ট্রাম্প দেশকে বিভক্ত করছে এবং এতে করে সংখ্যালঘুরা বিপজ্জনকভাবে ঘৃণার সম্মুখীন হচ্ছে এবং দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
৩। এরা আগ্নেয়াস্ত্রের যত্রতত্র ব্যবহারে শঙ্কিত। এদের অনেকেই আগ্নেয়াস্ত্র পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তবে অধিকাংশ শুধু সীমিত করার পক্ষে।
৪। ট্রাম্প সমর্থকদের মতো এরাও মনে করে শ্রমিকরা এবং সাধারণ মানুষ অবহেলিত, তবে ট্রাম্প এদের সত্যিকারের সমর্থক নয়, ট্রাম্প বড়লোকদের সমর্থক।
৫। ট্রাম্প সমর্থকদের মতো এরাও মনে করে এস্টাব্লিশেমেন্ট সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেনা, কিন্তু এরা মনে করে ট্রাম্প একজন প্রতারক ও ফ্যাসিস্ট, নিজের ভালো ছাড়া সে আর কিছুই বুঝেনা, তাকে দিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সম্ভব না।
৬। এরা পরিবেশ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। ট্রাম্প ও ট্রাম্প সমর্থকরা মনে করে ক্লাইমেট চেঞ্জ ভুয়া ও ষড়যন্ত্র।
৭। এরা মনে করে আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার যাতে করে অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমেরিকার মানুষও বিনামূল্যে বা কম মুল্যে ভালো চিকিৎসা পায়।
৮। প্রগতিশীল ও উদারপন্থী। এরা বিজ্ঞান, মানবাধিকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা, সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, নারীদের অধিকার, পরিবেশ রক্ষা এবং বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করে। তরুণদের মধ্যে, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাইডেনের সমর্থক না হলেও এরা মনে করে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে এসব বিষয়ে অনেক ভালো।
৯। এরা ট্রাম্পকে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা তার ব্যবহার ও চরিত্রের জন্য। সমীক্ষায় দেখা গেছে যারা বাইডেনকে ভোট দিয়েছে তার ৩০% তাকে সমর্থন করে, বাকি ৭০% তাকে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে।
ট্রাম্প বিরোধী উপরের বিভাগগুলো কিন্তু ব্লক বা কোয়ালিশন নয়, বুঝানোর জন্য আলাদা করা হয়েছে।
এই হল বিভক্ত আমেরিকা। এই বিভক্তি নতুন নয়। এমনকি এই বিভক্তি শুধু আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব জুড়ে মানুষের মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে, মানুষ উদার, সহনশীল ও প্রগতিশীল হচ্ছে। এই পরিবর্তনে অনেকেই উদ্বিগ্ন, অনেকেই তাদের পরিচয় খুঁজছে নতুন করে বা পুরনো পরিচয় আঁকড়ে ধরছে শক্তভাবে। রাজনীতিকরা এটার ফায়দা লুটছে বিভেদ আরও বাড়িয়ে দিয়ে, ভয় ও সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়ে। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতো আমেরিকায় সাদা খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের বীজ সবসময়ই ছিল। বিজেপি এবং ট্রাম্প নিজ নিজ দেশে এটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে এবং সম্মুখে নিয়ে এসেছে।
অনেকের মতে ট্রাম্প চলে গেলেও যে ঘৃণার আগুন সে জ্বালিয়ে গেছে তা সহজে নিভে যাওয়ার নয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট