চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাত প্রতিষ্ঠানের গবেষণা: করোনা ঠেকায় না বিসিজি টিকা

ইমাম হোসাইন রাজু 

১০ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:১৮ অপরাহ্ণ

করোনার সংক্রমণ কম হওয়ার পেছনে বিসিজি টিকার বড় ভূমিকা রয়েছে বলে এতদিন যে ধারণা পোষণ করা হতো, সেটি ভুল প্রমাণ করেছেন দেশের একদল চিকিৎসা গবেষক। দেশে করোনার হটস্পট খ্যাত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারাণগঞ্জের ১ হাজার ২১ জন রোগীর উপর গবেষণা চালিয়ে এমন তথ্য তুলে আনেন তারা। একই সাথে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের কোভিড সংক্রমণ বেশি হওয়ার যে ধারণা ছিল, তারও কোনো ভিত্তি মেলেনি গবেষণায়।

সদ্য বিদায়ী বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এ গবেষণা পরিচালনা করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতালসহ দেশের সাত প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা। তাদের গবেষণার ফল সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী ‘নিউ মাইক্রোবস এন্ড নিউ ইনফেকশান’ এর প্রবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ার’র অন্তর্ভুক্ত এ সাময়িকীটি ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয়।

গবেষণার তথ্যে জানা যায়, দেশের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ৯০ ভাগই ইতিপুর্বে সবগুলো টিকা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ‘বি’ পজিটিভ ব্লাড গ্রুপের রোগীরা। যাদের সংখ্যা ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয়স্থানে ‘ও’ পজিটিভ ব্লাড গ্রুপের। তাদের সংখ্যা ২৯ শতাংশ। এর বাইরে যারা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব থেকেই দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি কোভিড পরবর্তী জটিলতা দেখা গেছে বলেও গবেষণায় ওঠে আসে।

গবেষণাটি পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. ফারহানা আক্তার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ুব।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে অন্যান্য দেশে যেভাবে নির্দিষ্ট কিছু রক্তের গ্রুপের মানুষের কোভিড হবে বা বেশি আক্রান্ত হবে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।’

গবেষণায় আরও দেখা যায়, এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় দেড়গুণ করে প্রতিমাসে উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। উপসর্গযুক্ত রোগীদের অর্ধেকেরই ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী। আর আক্রান্তদের ৭৫ ভাগই পুরুষ। আক্রান্তদের মধ্যে ৩০ শতাংশের অধিক রোগীর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ডি ডাইমার এবং ফেরিটিন বেড়ে যায় এমন তথ্যও পাওয়া যায় গবেষণায়।

এছাড়া কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার চার সপ্তাহ পরেও আক্রান্তদের এক চতুর্থাংশের মধ্যে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, বিষন্নতা ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম বাধাগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। আর ৭০ ভাগ রোগীর চিকিৎসাতেই এজিথ্রোমাইসিন বা জিমাক্স এবং ৪৫ ভাগের ক্ষেত্রে ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহৃত হয়েছে। গবেষণায় শ্বাসকষ্টের রোগীদের মধ্যে কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পরেও উল্লেখযোগ্য হারে স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, মনোসংযোগ কমে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা ও ঘুমের সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে।

গবেষকদলের প্রধান ডা. হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘এই গবেষণায় কোভিড পরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং দেখা গেছে দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা মানুষজন বেশী ঝুঁকির মুখে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পর্যবেক্ষণের সাথে আমাদের এই গবেষণাফল সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া গবেষণায় কোভিড-পরবর্তী জটিলতার যে চিত্র পাওয়া গেছে তা ভবিষ্যতে এ রোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষজনের অন্যান্য রোগের ধরন অনুসরণে সহায়ক হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, ‘বিসিজি টিকা কোভিড থেকে সুরক্ষা দিতে পারে এরকম কোনো শক্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পাইনি। এছাড়াও ভবিষ্যতে সুস্থ রোগীদের এন্টিবডির মাত্রা নিয়ে তথ্য প্রয়োজন। তবে আরও অনেক বেশি রোগীর (অন্তত এক লাখ) উপর গবেষণা পরিচালিত হওয়া উচিত।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ুব বলেন, ‘দেশে উপসর্গবিহীন রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাদের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত কোন নতুন প্রজাতির বা ভিন্ন ধারার জিনগত গঠনের করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি এর পেছনে দায়ী কিনা।’

উল্লেখ্য গবেষণার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের দায়িত্বে ছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নঈম উদ্দিন হাছান চৌধুরী। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন রোগতত্ত্ববিদ ডা. মো. ওমর কাইয়ুম, ঢাকা মহানগর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ডা. সানজিদা হোসেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ডা. প্রসূন বিশ্বাস এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবদুর রব মাসুম। গবেষণার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল ডিজিজ বায়োলজি এন্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট