চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

‘শূন্য থেকে কীভাবে শুরু করি?’

তাসনীম হাসান

৫ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:২৮ অপরাহ্ণ

ধ্বংসস্তূপের মাঝে বসে কী যেন খুঁজছিলেন আবুল হোসেন। একটু পর আধপোড়া কাঠের বাক্সের ভেতর থেকে আগুনে নিঃশেষ হওয়া ছাইভস্ম বের করে আনেন তিনি। সেগুলোর দিকে নির্বাক তাকিয়ে ছিলেন। তখন তাঁর ক্লান্ত চোখ দুটিতে জল ছলছল করছিল। কোথাও যেন আটকে যাচ্ছিল বারবার। অধিক শোকে পাথর হওয়া বুঝি একেই বলে!

আবুল হোসেনের এই কষ্টের দশা হবেই বা না কেন? তিন দশক ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এক টাকা দু’ টাকা জমিয়ে চিটাগং আউটার রিং রোড সংলগ্ন সমুদ্রপাড়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। গত রবিবার রাতে আকমল আলী রোড হিসেবে পরিচিত ওই এলাকায় আগুনে যে ৪০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার একটি ছিল আবুলের সেই দোকানটি।

কী খুঁজছিলেন, এমন প্রশ্নে আবুল হোসেনের শুকিয়ে যাওয়া চোখে জল ফিরে আসে। বলে উঠেন, ‘আগুন আগুন’ শব্দ শুনে তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। এরপর চোখের সামনেই এক জীবনের সব সঞ্চয় পুড়ে যেতে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। একটু থেমে আবার কথা শুরু করেন আবুল হোসেন। বলেন, ‘আগুন লাগার পর থেকেই পাশের একটি দোকানের ভেতর সন্তান-আর স্ত্রীর ঠাই হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা বলতে গেলে সবাই প্রায় উপোস। তাই ক্যাশ বাক্সটির কাছে এসেছি; কোনো পয়সা হলেও অক্ষত আছে কিনা দেখতে। কিন্তু একটা টাকাও রাখেনি আগুন। এখন শূন্য থেকে কীভাবে শুরু করি! কী খাবো? কোথায় থাকবো?’

বলতে বলতে ফের কথা ডুবে যায় কান্নার জলে।  প্রায় ৩০ বছর আগে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসেন আবুল হোসেন। নানা সংগ্রাম-যুদ্ধের পর গড়ে তোলেন দোকানটি। সেই দোকানের সামনের অংশে চা-নাশতা বিক্রি করতেন আর পেছনের এক চিলতে কক্ষটিতে ঘুমিয়ে তিন সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রী কোনোরকমে জীবন পার করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু এক আগুন আবার পথে বসিয়ে দিল তাঁদের।

শুধু আবুল হোসেন নন, এখনো পুড়ে যাওয়া এলাকার আকাশে-বাতাসে কান পাতলে ভেসে আসে সবহারা মানুষের হাহাকার। পুড়ে যাওয়া বেশিরভাগ ঘরই ছিল মাছের আড়ত। সে সব আড়তে মাছ-জাল মিলিয়ে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার সম্পদ ছিল। এখন সবকিছুই কয়লা আর ছাই। একটি আড়তের মালিক মাহবুব আলম তাই কষ্ট মেশানো কণ্ঠে বলেন, ‘জান ছাড়া কোনো কিছুই বাঁচাতে পারলাম না।’ কীভাবে আগুন লেগেছে তা স্থানীয়রা কেউই বলতে পারছেন না। ফায়ার সার্ভিসও তদন্তের আগে কিছু জানাতে পারছে না।

অবশ্য কীভাবে এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবহারা মানুষগুলো। তাদেরই একজন শরিফুল ইসলাম। ওই এলাকার দোকান আর ঘরগুলোতে বিভিন্ন বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য এনে বিক্রি করতেন তিনি। শরিফুল বলেন, ‘৪০-৫০ হাজার টাকা মানুষ থেকে পাব। কিন্তু এখন তো সবাই সব হারিয়েছে। তাঁদের কাছে তো টাকাও দাবি করতে পারব না। আবার আমিও তো বাকিতে পণ্য আনি।’ তাঁর চোখেও তখন ছলছল জল। একটু পর তা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। সব হারিয়ে পথে বসা মানুষগুলোর এই চোখের জল হয়তো সহজেই শুকাবে না।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট