চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

একান্ত সাক্ষাৎকারে পতাকাকন্যা নাজমুন নাহার

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভ্রমণ করে যেতে চাই

মরিয়ম জাহান মুন্নী 

২ জানুয়ারি, ২০২১ | ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ

নানারকম রোমাঞ্চকর ঘটনা, এডভেঞ্চার, ভয়, খাবারের অভাবে প্রচণ্ড খিদা পেলেও হাল ছাড়েননি তিনি। নিজের স্বপ্ন পূরণে ছুটে চলেছেন দীর্ঘ ২০ বছর ধরে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল একের পর এক দেশ ঘুরবেন। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তার এ ছুটে চলা। বিশ্ব ভ্রমণকালে একমাত্র সাথী ছিলেন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।

এরইমধ্যে বিশ্বের ১৪৪টি দেশ ভ্রমণ করেছেন নারী হয়েই। চলার পথে ভুষিত হয়েছেন নানা পদকে। পৃথিবীর ১শ দেশ ভ্রমণ করেই তিনি জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে ফ্লাগ গার্ল উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তিনি নিজেই বলছেন তাঁর অবিশ্বাস্য এ বিশ্বভ্রমণের গল্পের কথা। করোনাকালেও বিশ্বের চারটি দেশ ভ্রমণ করে বাংলদেশ এসেছেন দেশের একমাত্র পতাকা কন্যা নামে খ্যাত নাজমুন নাহার। যার জন্ম লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার গঙ্গাপুর গ্রামে।

এ ভ্রমণকালে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতি, শিক্ষা ও মনবিকতা। কারণ বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ হয়েও মিয়ানমারের লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। গতকাল সকাল ১১টায় দেওয়ানহাট পানির কল এলাকায় নাজমুন নাহারের বোনের নিজস্ব ফ্ল্যাটে আলাপ হয়। আলাপকালে পতাকা কন্যা তাঁর বিশ্ব ভ্রমণের অনেক সুন্দর ও ভয়ঙ্কর স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। নিচে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

পূর্বকোণ: কেমন আছেন?
নাজমুন নাহার : আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। দেশের মাটিতে পা রাখতেই মন খুশিতে ভরে উঠেছে।
পূর্বকোণ: কোন দেশের মধ্যদিয়ে প্রথম বিশ্ব ভ্রমণ শুরু ?
নাজমুন নাহার: আমি সর্বপ্রথম ২০০০ সালে ভ্রমণ শুরু করি ভারত থেকে। সেখানে আমি একটা সমাবেশে যোগ দিয়েছি। সেই সমাবেশে বিশ্বের ৮০টি দেশের ছেলেমেয়েরা যোগ দিয়েছে। সেই সফরে সঙ্গী ছিলেন আমার মা।
পূর্বকোণ: ১৪৪টি দেশ আপনি একাই কি ভ্রমণ করেছেন ?
নাজমুন নাহার: মাত্র ১৪টি দেশে আমার সফরসঙ্গী ছিলেন মা। বাকি ১৩০টি দেশ আমি একাই সফর করি।
পূর্বকোণ: কত বছর বয়স থেকে আপনার বিশ্ব ভ্রমণ শুরু ?
নাজমুন নাহার: ২০ বছর বয়স থেকে।
পূর্বকোণ: এ পতাকাকন্যা বাংলাদেশে এসেছেন মাত্র ৭ দিন আগে। আমরা জানি আপনি এখনো বিয়ে করেন নি, এবার কী বিয়ে করার ইচ্ছে আছে ?
নাজমুন নাহার: যদি হয় তো ইচ্ছে আছে। না হলে বাকি যে দেশগুলো আছে সেগুলো ঘুরবো আর একটা বই বের করবো। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভ্রমণ করে যেতে চাই। এতদিন একটা সম্পর্কের বন্ধনে থাকতে চাইনি। তাই বিয়ে করিনি। এখন সংসার হলে সুন্দর করে সংসার করবো।
পূর্বকোণ: মানুষ অনেক রকমের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু আপনার এমন স্বপ্নের কারণ কী ?
নাজমুন নাহার: আমার বাবা-দাদা থেকেই আমি এ অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বাবা নিজেও চাইতেন বিশ্ব ভ্রমণ করতে। তিনি বলতেন, বিশ্বে অনেক কিছু জানার ও দেখার আছে। যা ঘরে বসেই জানা যায় না। বাবা দাদা উনিশ শতকের শুরুর দিকে বিভিন্ন আরব দেশে ঘুরেছেন। এক এক দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি এক এক রকম। তাই আমারও এ ইচ্ছে জন্মায় আমি একদিন দেখবো সারা বিশ্বকে।
পূর্বকোণ: এ চলার পথে কি কি বাধার মুখোমুখি হয়েছেন ?
নাজমুন নাহার: বিশ্বভ্রমণে বহু কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। তবে কিছু প্রাকৃতিক ও মানুষ দ্বারা বিপদের মুখে পড়েছি। মানুষের দ্বারা জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশে যাওয়ার সময় গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে বুক বিছিয়ে ৪ ঘণ্টা শুয়ে ছিলেন। গুয়েতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখোমুখি হয়েছে। সেখান থেকে ফিরে এসেছি আল্লার রহমতে। প্রাকৃতিক বিপদগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো সাহারা মরুভূমিতে ভয়ংকর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন। কিরগিজস্তানের আলাআরচা পর্বত সামিটে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে যাই। সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। ছোট্ট একটা বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম কোনোমতে। পেরুর রেইনবো সামিট পর্বতে যেখানে উঠি অতি উচ্চতার কারণে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। সেদিন মৃত্যুকে যেন খুুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। রাতের অন্ধকারে আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছিলেন।
পূর্বকোণ: ১৪৪টা দেশের মধ্যে আপনার কোন দেশগুলোর কথা বেশি মনে পড়ে ?
নাজমুন নাহার: আমার সবগুলো দেশের কথাই মনে পড়ে। তবুও কিছু উল্লেখযোগ্য দেশ আছে যেগুলোর স্মৃতি রাতে ঘুমানোর সময় আমার চোখে ভাসে। ঘুমের মধ্যেই আমি কখনো শিহরিত হই আবার কখনো ভয়ে ঘুমও ভেঙে যায়। এই যেমন চিলির আতাকামা, যেখানে ১শ বছরে বৃষ্টি হয়নি। এমন আশ্চর্যজনক জায়গায়ও আমি গিয়েছি। জর্জিয়ায় গ্লেসিয়ার মাউন্টেনের আরোহণ করি। যেখানে পাথরের সৌন্দর্য আমাকে খুবই মুগ্ধ করে। এ স্মৃতি এখনো আমাকে শিহরিত করে। ওই শিহরণই আমাকে পরবর্তীতে পৃথিবীর বাকি ১১০টি দেশে যেতে আগ্রহী করে তুলে।
পূর্বকোণ: একের পর এক দেশ যেতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়, এ টাকা আপনি কোথায় পেয়েছেন ?
নাজমুন নাহার : প্রথম কয়েকটি দেশভ্রমণ করেছি বাংলাদেশ গার্লস গাইড এসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে। তারপর বৃত্তি নিয়ে চলে যান সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশোনাকালে চাকরিও করি। সেসময় বিশ্ব-ভ্রমণের লক্ষ্যে অর্থ সঞ্চয়ের জন্যে প্রচুর কাজ করেছি। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কোন কোন দিন আছে আমি ১৭/১৮ ঘণ্টাও কাজ করেছি। আমি জানতাম উপার্জন না করলে আমি ভ্রমণ করতে পারবো না। এছাড়া ইউরোপে থাকার কারণেও আমার এই ভ্রমণে কিছুটা সুবিধা হয়েছে।
পূর্বকোণ: ভ্রমণকালে খাবারের কি কি সমস্যায় পড়তে হয়েছে ?
নাজমুন নাহার: যখন যেখানে গিয়েছি সেখানেই সেই দেশের মানুষের সাথে সে সব খাবার খেয়েছি। এখনো মনে পড়ে ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে কাঁচা গরুর মাংস খেয়েছি। আফ্রিকায় তিন মাস আলু খেয়েছি। সর্বোচ্চ আড়াই দিন খাবার না খেয়েও ছিলাম। আফ্রিকায় গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুই দিন পানির পিপাসা মিটিয়েছি।
পূর্বকোণ: এতগুলো দেশে ভ্রমণ করতে সব সময় কি ভিসা পেয়েছেন ?
নাজমুন নাহার : সব দেশে ভ্রমণ করতে ভিসা পেয়েছি বলা যায় না। আবার আমি সড়কপথে ভ্রমণ করেছি দিনের পর দিন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছতে সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা, কখনো ৪৮ ঘণ্টা, কখনো ৩৬ ঘণ্টা বাসে জার্নি করেছি। আমি বাংলাদেশ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেই আবার উচ্চতর ডিগ্রির জন্য সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে যাই। সেখানে গবেষক হিসেবে কাজও করেছি। এছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রাইটস ও এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তাই আমি সহজেই কিছু কিছু দেশের ভিসা পেয়েছি। কখনো আমি ১৫টা দেশ তিন থেকে পাঁচ মাসে সড়কপথেও ভ্রমণ করেছি।
পূর্বকোণ: মেয়ে হয়ে এমন স্বপ্নপূরণে কোনো বাধা আসেনি ?
নাজমুন নাহার : না, আমার পরিবার আমাকে উল্টো সমর্থন দিয়েছে।
পূর্বকোণ: সর্বশেষ কোন দেশের মধ্য দিয়ে এবারের ভ্রমণ শেষ হয় ?
নাজমুন নাহার: লোহিত সাগরের পার্শ্ববর্তী আফ্রিকা মহাদেশের জিবুতি, সোমালিল্যান্ড, সুদান ও মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশ আসি।
পূর্বকোণ: চলার পথে কি কি এওয়ার্ড পেয়েছেন ?
নাজমুন নাহার : যুক্তরাষ্ট্রে পিস টর্চ বিয়ারার এওয়ার্ড, আর্থ কুইন এওয়ার্ড, জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে ফ্লাগ গার্ল উপাধি, জনটা ইন্টারন্যাশনাল দিয়েছে গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ এওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল এওয়ার্ডও পেয়েছি।
স্বপ্নযাত্রী’র সংবর্ধনা
শুক্রবার (১ জানুয়ারি) শিল্পকলায় এওয়ার্ড, ক্রেস্ট ও উত্তরীয় পরিয়ে তাকে সম্মাননায় ভূষিত করেন স্বপ্নযাত্রী সংগঠন। তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংবাদিক এজাজ ইউসূফী, লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর মো. এম এ কাশেম ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু।

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট