চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ছেলের চাকরিতে আকাশে মা

তাসনীম হাসান 

৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ | ২:৩২ অপরাহ্ণ

ঘরের ওপর দিয়ে কোনো উড়োজাহাজ উড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনলেই এক দৌড়ে উঠোনে চলে আসতেন গীরু বালা রায়। এরপর সেই উড়োজাহাজ দেখতে দেখতে আফসোস করতেন এই বলে ‘একদিন যদি চড়তে পারতাম!’ কিন্তু যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা সেখানে উড়োজাহাজে চড়া যে এক লাফে এভারেস্টের চূড়ায় উঠার মতোই দুঃস্বপ্ন। তবুও মাকে কথা দিয়েছিলেন ছোট ছেলে শিপন রায়। বলেছিলেন চাকরি হলেই পূরণ করবেন মায়ের স্বপ্ন। অবশেষে মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

গতকাল বুধবার বিকেলে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে চড়িয়ে মাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে উড়িয়ে আনেন শিপন রায়। এর আগেরদিন মঙ্গলবারেই ৩৮ তম বিসিএসের নন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন মায়ের আদরের শিপন রায়।

শিপন রায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এম এ প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। এখন এমফিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর মাঝেই এলো তাঁর চাকরির সু-সংবাদ। অবশ্য বসতভিটাহীন পরিবারের বাবাহারা ছেলে শিপন রায়ের এতদূর আসার পেছনের গল্পটা নিয়ে চাইলে একটা পুরো ছায়াছবিই করা যাবে। শিপন কী করেননি একজীবনে? রিকশা চালানো থেকে চুল কাটা, ধান রোপণ থেকে কাঁকড়া বিক্রি সব পেশাতেই তাঁর হাত বসাতে হয়েছে জীবনের তাগিদে। এই করোনাকালীন সময়েও গ্রামে গিয়ে ৭০ শতক জায়গায় নিজেই আমনের বর্গাচাষ করছেন।

শিপনের জীবনের সেই গল্প বলার আগে মাকে উড়োজাহাজে চড়ানোর গল্পটা শোনা যাক তাঁর মুখ থেকেই। শিপন রায় বলেন, নন ক্যাডারে সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত হতেই তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ি মায়ের স্বপ্নপূরণে। নানা জায়গায় যোগাযোগ করে প্রায় মধ্যরাতে জোগাড় করি উড়োজাহাজের টিকিট। বুধবার ভোরে ফেনীর সোনাগাজীর চরচান্দিয়ার বাড়ি থেকে রওয়ানা হই ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। বিকেল তিনটার ফ্লাইটে চড়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে পুনরায় ঘরে ফেরা।’

মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে পেরে হাসি ফুটেছে শিপন রায়ের মুখেও। তাই বলেন, ‘মায়েরও বয়স বাড়ছিল। এখন বাষোট্টির ঘরে। নানা রকম অসুখ বাসা বাঁধছিল জীর্ণশীর্ণ শরীরে। মনের ভেতর তাই ক্রমাগত ঘুরফাঁক খেত একটা প্রশ্ন ,মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে পারবো তো? সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, চাকরিটা দ্রুতই হলো।’

বিমানবন্দর আর উড়োজাহাজের ভেতরে মায়ের সঙ্গে স্মারক হিসাবে নানা ছবি তুলে রেখেছেন শিপন রায়। তার একটি ছবিতে দেখা যায়, ধপধপে সাদা শার্ট পরা ছেলের পাশে বসে আছেন মা গীরু বালা রায়। মুখজুড়ে উপচে পড়ছে হাসির ঢেউ। হাত উঁচিয়ে  ছেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেখাচ্ছেন ভি চিহ্ন।

চট্টগ্রামে নামার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে গীরু বালা রায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘একজীবনে আমার দুটো স্বপ্ন ছিল। ছেলের চাকরির খবর শোনা আর উড়োজাহাজে চড়া। দুইদিনে দুটোই পূরণ হয়ে গেছে। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই।’

২০০৯ সালে যখন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনি বাবা স্বপ্ন রায়কে হারান শিপন। অবশ্য অভাবের সংসারে দুঃখ-কষ্ট লেগে ছিল বারোমাসই। শিপনের মা গীরু বালা রায়ের সারাজীবনই কেটেছে এ ঘরে ও ঘরে কাজ করে। এখন ষাটোত্তীর্ণ বয়স বলে সেটিও আর পারেন না। শিপনের এক ভাই নাপিতের কাজ করেন। আরেক ভাই রিকশা চালান। বিয়ে করে তাঁরা দুজনেই আলাদা সংসারে উঠেছেন। তিন ভাই মিলে মায়ের খরচ জোগান। বলতে গেলে মাথা গোঁজার জন্য বসতভিটা তোলার একটুকরো জায়গাও নেই তাঁদের।

সেজন্য পড়ালেখা চালিয়ে নিতে প্রায় সব কাজেই হাত দিতে হয়েছে শিপনকে। শিপন হাসতে হাসতে বলেন, ‘২৮ বছরের জীবনে ২৬ রকমের কাজ করেছি। নাপিতের কাজ করেছি প্রায় ১০ বছর। মানুষের ঘরের টয়লেটও পরিষ্কার করেছি। জমিতে কাজ তো এই কদিন আগেও করলাম।’

অবশ্য এই দীর্ঘ সংগ্রামমুখর সফরে শিপন পেয়েছেন মানুষের নানা সহযোগিতাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের শুরু থেকেই পাচ্ছেন ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘পে ইট ফরওয়ার্ডের’ বৃত্তিও। করোনায় টিউশনি হারালে আবারও পাশে দাঁড়ায় এই সংগঠন। এখান থেকে পাওয়া ১০ হাজার টাকায় নিজের গ্রামে ৭০ শতক জমিতে আমনের বর্গাচাষ করেছেন। এখন সেই ধান ঘরে তুলেছেন।

মানুষের এই ‘ঋণ পরিশোধে’ প্রায় সময় অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন শিপন। করোনার সময়ে গ্রামে লাশ সৎকারে এগিয়ে গেছেন। গড়ে তুলেছেন প্যারেন্টস কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংগঠনও। যেটির মাধ্যমে তিনি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চুল-দাঁড়ি কেটে দিয়ে প্রশান্তি জোগান। অন্যের কাছ থেকে কাপড়চোপড় এনে তুলে দেন তাঁদের গায়ে।

শিপন বলেন, ‘এখন চাকরিটা হওয়ায় মানুষকে আর্থিকভাবেও সহায়তা করতে পারবো। এর চেয়ে আনন্দ হয় না।’ তবে সব আনন্দ যেন ছাপিয়ে গেছে মাকে উড়োজাহাজে চড়িয়ে স্বপ্নপূরণ করতে পারার আনন্দের কাছে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট