চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জনপ্রতিনিধি হয়ে এখন মানুষের পাশে

মরিয়ম জাহান মুন্নী 

২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:০৩ অপরাহ্ণ

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর সংসারে গেলেও পূরণ হলোনা সংসার করার স্বপ্ন। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে তিন দিনের মাথায় ভেঙে গেল তার সব স্বপ্ন। প্রতিদিনের অত্যাচার সহ্য করেও চেয়েছিলেন স্বামীর সংসার করতে। এমনকি ফুটন্ত গরম পানিতে পুরো শরীর জ্বলছে যাওয়ার পরও করতে চেয়েছেন সংসার। কিন্তু কাল হলো কন্যা সন্তানের মা হওয়া। তিন বছরের মাথায় ভেঙে গেল সংসার। দুঃখের এখানেই শেষ নয়, এর পরপরই সড়ক দুর্ঘটনায় হারান বাবাকে। একের পর এক বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালের তিনি। অবশেষে তাঁর সামনে ধরা দিয়েছে সাফল্য। তিনি এখন নিজেই একজন জনপ্রতিনিধি ও সফল উদ্যোক্তা।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার লড়াইয়ে এতদূর আসা এই নারীর নাম আয়শা আক্তার আজাদী।  জীবন সংগ্রামে লড়াই করা এই নারী সেই কষ্টের পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২০ সালের মা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের সেরা পাঁচ জয়িতার একজন হয়েছেন তিনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার লড়ায়ে চন্দনাইশ উপজেলা থেকে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হলেন তিনি।

তাঁর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে আয়শা আক্তার বলেন, বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। চার ভাইবোনের পড়ালেখা ও সংসার চলতো বাবার উপার্জনে। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় বাবার চাকরি চলে যায়। ফলে ভাইবোন সবার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বাবা অসুস্থ হওয়ার কারণে মামাদের উপর আমাদের পরিবার  নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে বাবা-মায়ের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মামাদের কথায় আমাকে বিয়ে করতে হয়। বাবার শেষ সম্বল পেনশনের কিছু টাকা ছিল, তা দিয়েই আমার বিয়ে হয়। বরপক্ষের চাপে বাবাকে ছেলেদের যৌতুক দিতে হয়েছে। কিন্তু তারা সেই টাকায় খুশি হয়নি। বিয়ের তিনদিন পরেই আমার উপর শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে জামাইও ভয়ংকর রূপ দেখাতে শুরু করে। বাবা তাদের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেনি কেনো তা নিয়ে প্রতিদিন চললো নানারকম অত্যাচার। শারীরিক-মানসিক সবরকম নির্যাতন দিন দিন আমার উপর চলতে থাকে। এ নির্যাতন শুধু আমার উপরই নয়, আমার বাবা-মাকেও নানারকম মানসিক চাপের উপর রাখতো তারা। আমার ছোট ভাইবোনরাও এ নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। বিয়ের তিনমাসের মাথায় তারা বলে আমার স্বামী বিদেশ যাবে তাই তাদের তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা আমার বাবাকে দিতে হবে। স্বামী ও শাশুড়ি তাদের দাবিকৃত টাকা না পাওয়ায় আমার উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।

তারা বলে বিদেশ যাওয়ার খরচ যদি আমার বাবা দিতে না পারে তবে তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখা যাবে না। স্ত্রী হিসেবে আর তাদের কাছে কোনো দাবি করা যাবে না। এর কিছুদিন পরেই আমার স্বামী বিদেশ চলে যায়। তিনি আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। সেই সময় আমি গর্ভবতী ছিলাম। আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় আমি সব নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য  করেছি। তারমধ্যে শ্বশুর জানিয়ে দেয় যদি ছেলে হয় তাহলেই স্বামীর ঘরে থাকা যাবে। আর কন্যা সন্তান হলে আমি ও আমার সন্তান দুইজনকেই চলে যেতে হবে। গর্ভাবস্থায় তারা আমার উপর চালিয়েছে অমানবিক অত্যাচার। মরিচ বাটা, মসলা বাটা, ধান নেওয়া, ধানের ভারী বস্তা মাথায় নেয়া থেকে হাত দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজ ও ঘরের সব কাজ করাতো। এই ধান মাড়াইয়ের কাজ গভীর রাত পর্যন্ত করাতো। এতো কাজ করে আমি যখন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তাম। তাদের চাহিদা মত কাজ করতে না পারলে সেদিন আমাকে আর ভাত খেতে দিতো না। সারাদিন এমন কাজ করে ঘুমাতে গেলে ফ্যানটাও চালাতে দিতো না। বলতো বিদ্যুৎ বিল কে দিবে। এমন গরমের দিনে তারা  আমার চৌকিতে ধানের বস্তা রেখে দিতো। ধানের গরম আর ধুলাবালিতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাছাড়া প্রসবকালীন সেবাও পাইনি। বাড়িতে ধাত্রী এনে প্রসব করানো হয়। একদিন একরাত কষ্ট পাওয়ার পর আমার একটা মেয়ে জন্ম হয়। মেয়ে হওয়ার খবর শুনে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। মেয়ে কেন হয়েছে তার জন্য আমাকে ডিসেম্বর মাসের শীতের মধ্যে পুকুরে গোসল করতে হয়েছে। কোনো রকমে পুকুর থেকে উঠে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারা আমাকে একটা ডাক্তারও দেখায়নি। বিকেলের দিকে আমার বাবা এসে আমাকে ডাক্তার দেখায়। এর জন্য তারা আমার বাবাকে অনেক অপমান করে। এরপরে শুরু হয়েছে আমাদের মা-মেয়ের উপর অত্যাচার।

সারাদিন আমার মেয়েকে দুধ খাওয়াতে দিতো না। মেয়ে দুধের জন্য কান্না করলে চালের গুঁড়ি গরম করে খাইয়ে দিত। এরজন্য আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু করে। কিন্তু তারা আমার মেয়েকে ডাক্তার দেখায় না। এরপরে একদিন শাশুড়ি আমার শরীরে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দেয়। এতে আমার কোলে থাকা মেয়েও পুড়ে যায়। বাবা এসে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করেন। এতো নির্যাতনের পরও আমি আবার শ্বশুর বাড়ি যাই। পরে আমার শ্বশুর কল দিয়ে আমাকে নাইয়র নিতে বললে বাবা এসে নিয়ে যায়। এর কয়েকদিন পরে আমার স্বামী ডিভোর্স লেটার পাঠায়। বাবা এর কারণ জানতে চাইলে আমার শ্বশুর বলেন কন্য সন্তানের মায়ের জায়গা আমার ঘরে নেই। এটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। এরপরে বাবা মামলা করে দেনমোহরের কিছু টাকা আদায় করেন। এসব কারণে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেয়ার পথে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যায়।

এরপরে সুস্থ হয়ে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়ি। এলাকার বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করি। ভাইয়ের সহযোগিতায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করি। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করি। এনজিও সংস্থার সাথে প্রত্যক্ষভাবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করি। বাড়ি গিয়ে ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয় মুখি করি। নিজে হাঁস-মুরগির একটা খামার করি। এটাই আমার আয়ের প্রধান উৎস। পরে এলাকার মানুষের ইচ্ছায় আমি ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করি। এরপর নারীদের উন্নয়নে নানামুখী কাজ করি ও বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারের আয়োজন করি। আমি চাই আমার মত আর কোনো নারী যেন এ রকম কষ্ট না পায়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট