চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

করোনায় আয় কম, পেট ভরে না ঘোড়ার

তাসনীম হাসান

২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ | ২:০৫ অপরাহ্ণ

ছোট ছোট কয়েকটি বালতি। সেগুলোর কোনোটিতে কাটা ঘাস। আবার কোনটিতে গমের খোসা। পরিমাণে খুবই অল্প। বালতিগুলো ঘিরে সামান্য সেই খাবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছিল ছয়টি ঘোড়া। তাতে যে উদরপূর্তি হচ্ছে নাতা ঘোড়াগুলোর ক্লান্তিহীন ডাকাডাকি আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল বুঝিয়ে দিচ্ছিল। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এই ঘোড়াগুলোর দেখা মিলে নগরীর সাগরিকা রোডের রেললাইনের পাশের একটি খামারে। ঘোড়া ভাবতেই যে টানটান শরীরের চতুষ্পদ প্রাণীর ছবি সবার চোখে ভাসে তার ছিটেফোঁটাও নেই এগুলোর শরীরে। সেগুলো এতই হাড় ঝিরঝিরে দশা যেপ্রথম দেখায় মনে হবে গরুর বাচুর।

উত্তর কাট্টলি থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলাকায় পথে পথে চোখ রাখলেই এমন অনেক ঘোড়ার দেখা মিলে। বিভিন্ন বিয়েবাড়িতে বর-কনেকে ঘোরানো, নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন এবং পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও রাসমনি ঘাট এলাকায় পর্যটকদের চড়ানোয় এই ঘোড়াগুলোর কাজ। কিন্তু করোনার কারণে তাদের সেই কাজে টান পড়েছে। ঘোড়ার মালিক আর সহিসদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর প্রথম ছয় মাস একেবারেই বন্ধ ছিল তাদের ব্যবসা। এখন বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলেও তাতে আগের মতো জৌলুশ নেই। ফলে ঘোড়ায় চড়ার মতো শৌখিনতা অনেকাংশই কমে গেছে। আবার সৈকতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লেও করোনার কারণে ঘোড়ার পিঠে উঠে বেড়ানোতে কেউ তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীদের নিজেদের খাবার সংস্থান করতে যেখানে জেরবার সেখানে ঘোড়ার পেটভরার ব্যবস্থা করা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুঃসাধ্য। এরপরেও টুকটাক যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে কোনোমতে নিজেদের জীবন গুজরানের পাশাপাশি ঘোড়াদের পেট ভরানোর চেষ্টাও করে যাচ্ছেন তারা।

স্বাভাবিকভাবে একটি ঘোড়া দিনে ৮ থেকে ১০ কেজি খাবার খেতে পারে। বার্লি, ঘাস আর গমের ভুষি মিশ্রিত খাবার খেতে অভ্যস্ত ঘোড়া। কিন্তু এখন আয় তেমন না থাকায় তার অর্ধেক খাবারও  পাচ্ছে না ঘোড়াগুলো।

সেটিই জানালেন সাগরিকা এলাকার মোহাম্মদ মামুন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও মো. আবদুল নামের তিন ঘোড়ার মালিক। তাদের ১০টি ঘোড়া আছে। এর মধ্যে দুটি বাচ্চা। পিরোজপুর থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে এসে দীর্ঘদিন ধরে তারা ঘোড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। আয় কমে যাওয়ায় রেললাইনের পাশের দরজা-জানালাহীন ছোট্ট একটি বেড়ার বাসায় ঠাঁই নিয়েছেন এই তিন ব্যবসায়ী।

তাদের মধ্যে মোহাম্মদ মামুন পূর্বকোণকে বলেন, ‘ঘোড়াগুলোকে এখন ২ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে এক বস্তা ভুষি আর দুই বস্তা কুঁড়া এনে তিনদিন খাওয়াচ্ছি। কিন্তু এই খাবার একেবারেই স্বল্প। তাই পেট ভরে না ঘোড়াগুলোর। কিন্তু এ ছাড়া তো উপায় নেই।’

ব্যবসা কমে যাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় মামুনের গলা থেকে। তিনি বলেন, আগে সপ্তাহে তিন-চারদিন অনুষ্ঠান পেতাম। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হতো। এখন সেখানে সপ্তাহে একদিনও পাইনা। আবার পেলেও করোনার অজুহাতে আগের মতো টাকা দিতে চায় না। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। এর সঙ্গে মাস শেষে ঘোড়াগুলো রাখার জন্য তিন হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হয়। ঘোড়ার খাবার আর রাখার টাকা জোগানোর পর আর আমরা তিনটা মানুষ খাই কী, ঘরে কী পাঠাই?

এরপর পতেঙ্গা সৈকতে গেলে পাওয়া যায় ঘোড়ার সহিস মোহাম্মদ ফয়সালকে। সৈকতে ঘুরতে আসা মানুষকে ঘোড়ায় চড়ার জন্য নানা প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছিল এই কিশোর। কিন্তু তাতেও কারও মন গলছিল না। হতাশ ফয়সাল তাই প্রশ্ন ছুঁড়েন ‘কখন যে সব স্বাভাবিক হবে?’ যখন সে কথা বলছিল তখন ঘোড়াটি খাবারের জ¦ালায় ঝিমাচ্ছিল।

তাই কে বলছে মানুষই শুধু করোনামুক্ত পৃথিবীর অপেক্ষায় আছে। ক্ষুধায় কাতর এই অবলা প্রাণিগুলোও যেন সেই একই অপেক্ষায় আছে !

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট