চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শিক্ষা বিকাশে গণ-গ্রন্থাগার

আবদুল হামিদ

১৫ জুন, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

একাধিক বইয়ের সমষ্টি, গ্রন্থাগারের সৃষ্টি! বইয়ের সব ভালোবাসা নিরুপম হয় গ্রন্থাগারে। গণ-গ্রন্থাগারে যে বই সমাবিষ্ট থাকে সে বই জ্ঞানের ভা-ার, মানুষের মনুষ্যত্বের স্বপ্নের সিঁড়ি আর পরম বন্ধু। সেই বই পাঠ করার মাধ্যমে জানা যায় এই সোনালি বিশ্ব জগত। জানা যায় মানুষের সহ¯্র মনোভাবনা এবং পাওয়া যায় আনন্দ। গ্রন্থাগারে লক্ষাধিক বইয়ের সজ্জিত প্রাণ যে নিরুপম করা যায় তা নয়, সেই বইটুকু পাঠ করে যাওয়া যায় স্বপেড়বর রাজ্যে, যাওয়া যায় জ্ঞানের রাজ্যে। মানুষের মনতুষ্টির জন্য প্রয়োজন গণ-গ্রন্থাগারের সমাবিষ্ট নানান বই। আমি এখানে গণ-গ্রন্থাগারের সমাবিষ্ট সব বই উলেখ করার মানে হচ্ছে গণ-গ্রন্থাগারে সব বিষয়ের বই সজ্জিত থাকে। সেই সমাবিষ্ট বই হলো —বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি। মানুষের শিক্ষার উপায় নানান ধরনের হতে পারে। যেমন আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং সনদ-কর্তৃক শিক্ষা অর্জন করা যায়। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা গণ-গ্রন্থাগারে সমাবিষ্ট বই থেকে অর্জন করা যায়।মানুষ যে যেরকম বই পড়ে শিক্ষা অর্জন করুক না কেনো -প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপরের স্থান হিসেবে গণ-গ্রন্থাগারের শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে মনের দাবি মেটানোর একমাত্র পথ হচ্ছে গণ-গ্রন্থাগারের গল্প, নাটক, কবিতা, উপন্যাস এবং সামাজিক নানা বই। মানুষেরা এই বই পাঠ করার মাধ্যমে মনের দাবি মেটাতে পারে। তাছাড়া, মানুষের মনের দাবি রক্ষা না হলে মানুষের আত্মা বাঁচে না। তখন মানুষের মনে হয় নিকষকালো আঁধারের পথে টগবগ করে পথিক পথ পেরুচ্ছে। মানুষের মনের কোণে যে সজীবতা থাকে সেই সজীবতা রুক্ষ্ম প্রাণে বিস্তার লাভ করে। আত্মার সজীবতা লাভ করতে না পারলেই জাতির প্রাণ যথার্থই স্ফূর্তি লাভ করতে পারে না। ফলে, সেই কারণে সকল মানুষের মনে হয় প্রাণসব নির্জীব, নিষ্প্রাণ।
মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেমন গুরুত্ব, তেমনই গ্রন্থাগারের শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়-গ্রন্থাগার কিভাবে শিক্ষা দেবে?
আমি বলি নিজের কাজ যেমন নিজেই করার মধ্যে প্রকৃত সার্থকতা নিহিত, তেমনি গ্রন্থাগারে নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য নিজে নিজেই বই পড়ার সার্থকতা নিহিত। গণ-গ্রন্থাগারে বই পড়ে মানুষ নিজেকে সমাজের একজন সু-শিক্ষিত দাবি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, যারা গণ-গ্রন্থাগারে প্রতিনিয়ত বই পড়ায় অভ্যস্ত তাঁরা কখনো মুর্খ থাকতে পারে না।বই যেমন সু-শিক্ষার ভা-ার, তেমনই মানুষের পরম বন্ধু। আর বন্ধুর মাঝে যখন শিক্ষিত মনোভাব তখনই অপর বন্ধু অশিক্ষিত আর মূর্খতা ত্যাগ করতে চায়।
গণ-গ্রন্থাগারে বই পাঠের মাধ্যমে বিস্তৃত করা যায় মনের ভুবন এবং স্বপ্নের সাগর। একটি গণ-গ্রন্থাগার মানে একটি মহাসাগর। মহাসাগর যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির কণা নিয়ে সৃষ্টি। তেমনই একটি গ্রন্থাগার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত বইয়ের সমষ্টি। আর, সেই বই পাঠ করার মাধ্যমেই জ্ঞানের প্রাসাদ গড়ে তোলা সম্ভব। আমার মতে পৃথিবীর যত জ্ঞানী-গুণী এভারেষ্ট চূড়ার মতো দাঁড়িয়ে এই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গণগ্রন্থাগারের সমাবিষ্ট বইয়ের শিক্ষায় অত্যন্ত বিভোর ছিলেন। তাই, তারা এই পৃথিবীকে জয় করতে পেরেছিলেন। বর্তমান সমাজ যেভাবে নানা কূটনৈতিক কাজে এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষে লিপ্ত সেভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর বয়স শেষ না হওয়ার আগেই পৃথিবীর বিলুপ্তি ঘটবে। সেই ঘটনাবলী এড়ানোর জন্য একমাত্র অবলম্বন হলো গণগ্রন্থাগার। মানুষের সু-শিক্ষার জন্য আত্মশুদ্ধির জন্য গ্রন্থাগারের সমাবিষ্ট বইয়ের পাঠগ্রহণ আবশ্যক। এই শিক্ষার কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পেলে মানুষের অবস্থান পৌঁছে যাবে; জ্ঞান গরিমায় চূড়ায়, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার স্বর্ণ-শিখরে।
গণগ্রন্থাগারকে মানুষের মানবাত্মার বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত করা হয়। গ্রন্থাগারে মানুষের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার অর্জন করা যায়। গণগ্রন্থাগার সমাজের নীতি, আদর্শ, ন্যায়-বোধ, সুবোধ ইত্যাদি জাগ্রত করার স্থান। শিশুদের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু মনন গড়ে তুলতে গণ-গ্রন্থাগারের দায়িত্ব অপরিসীম। গণগ্রন্থাগার মানুষের মূল্যবোধ কে জাগ্রত করে। মানুষ দুঃখ-কষ্ট হাসি-কান্না ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে গ্রন্থাগারের মাধ্যমে। গ্রন্থাগার সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজের সকল মানুষের জ্ঞানোদয় করার জন্যে গণ-গ্রন্থাগার বিরাজ করে জ্ঞানের নির্যাস, সত্য ও সুন্দরের অমৃতবলয়।
গণ-গ্রন্থাগারে থাকে হাজারো বইয়ের কলোল এবং তার প্রতিটি পৃষ্ঠায় সঞ্চিত থাকে হাজারো বছরের সমুদ্রের কলোল। মানুষের অতীত এবং বর্তমানের সংযোগ সেতু হলো বই। আমরা গণ-গ্রন্থাগারে যে বই পড়ি তা দিয়ে আমরা জানতে পারি সত্য, সুন্দর, কল্যাণ, ন্যায়ের শাশ্বত রূপ। বই যেহেতু আমাদের বিশ্বজগত সেই হিসেবে আমরা গণগ্রন্থাগার কে বিশ্বজগতের দরজা বলতে পারি। মানুষের নতুন কিছু জানার জন্য, নতুন কিছু শেখার জন্য, নতুন কিছু জ্ঞান আহরণের জন্য গণগ্রন্থাগার এবং বই খুবই প্রয়োজনীয়। গণ-গ্রন্থাগারে আমরা প্রতিনিয়ত নানান বইয়ের উন্মোচন দেখি।
নানান বইয়ের সাথে পরিচিতি হই। সেই বই আমাদের মনের প্রসার ঘটায়। নির্মল আনন্দ লাভে এবং মানুষের মূর্খতা এড়াতে বইকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বই পড়ার মাধ্যমে গুণীজনের নানান ভাষ্য জানলে তা বুঝা যায়। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন: ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়”!
বর্তমান যুগে ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির কারণে বলা হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে বই পড়া। আর, দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে সভ্যতার ইতিহাসে হাতছানি অসভ্যতার। যে অসভ্যতার কারণে দিন দিন ছেলেমেয়ে নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে সুন্দর সমাজ। কমে যাচ্ছে গণগ্রন্থাগার। কমে যাচ্ছে সৃষ্টিশীলতা আর শাশ^ত সুন্দরের অভিযান। সেই অন্ধবেগ কমাতে গণগ্রন্থাগারের মূল্য অপরিসীম।
মানুষ সভ্যতা খুঁজে, সমাজের বিকাশ খোঁজে। আবার দেখা যায়, যে বই আজ পড়তে শুরু করেছে তার মধ্যে কিছু কারণ হলো চাকরি পাওয়া আর একটা সার্টিফিকেট অর্জন। যার মূল্য নেই বললেই চলে। আজকের দুঃসময়ে জ্ঞান আহরণের জন্য মানুষ বই পড়ে, এমন মানুষ শতের মাঝে দু’এক জন আছে কিনা সন্দেহ। বর্তমান প্রেক্ষাপট নতুন প্রজন্মের প্রতি অত্যন্ত ক্ষতিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি অনেক জ্ঞানী-গুণী খতিয়ে দেখে- নবচিন্তার গণগ্রন্থগারে যে বই সজ্জিত করছে তা মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী এবং শিশুদের মনকে অনেক প্রফুল্ল রাখবে।
গণগ্রন্থাগারে যে বই সংরক্ষিত থাকে সেই বইয়ের পাতায় কালো অক্ষরে অমর হয়ে আছে মানুষের চিরন্তন দ্যুতি। বই মানুষের ভালোবাসার প্রতীক। বই পাঠ করে পাওয়া যায় অনাবিল আনন্দ এবং সতেজতা। গণ-গ্রন্থাগারে হাজারো বইয়ের জগতে যে ভ্রমণ করেছে, তাঁর অন্তর হয়েছে ঐশ্বর্যময়, হয়েছে আলোকিত। বই পড়ে জানতে পারে মানুষ সত্য মিথ্যার পার্থক্য। গড়তে পারে জ্ঞানের শহর। আর সেই শহরে পৃথিবীর সর্বোত্তম শিক্ষার প্রাসাদ গড়ে তুলতে পারে।
এক কথায়, গণগ্রন্থাগার মানব-আত্মার বিশ্ববিদ্যালয়। যার প্রতিটি নির্মাণে জ্ঞানী পাথরের সমাবেশ। আর প্রতিটি শিক্ষায় আহরণ হয় শ্রেষ্ঠ রত্ন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট