চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণমানুষের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী

কাজী গোলাপ রহমান

১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৪:১৬ অপরাহ্ণ

আজ ‘চট্টলবীর’ খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চসিক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি চট্টগ্রামবাসীর খুবই প্রিয় রাজনীতিক ছিলেন। সারাজীবনই তিনি জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এরপর শ্রমিকলীগের নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন হয়েছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম, বরগুনা ও কিশোরগঞ্জে। দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের লক্ষ নিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী, চট্টগ্রামের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলাভী ছৈয়দ, এসএম আবু ইউসুফ ও তাদের অনুসারিরা। তার চিন্তা-চেতনা ধ্যান-ধারনা সবই ছিল চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের গণমানুষকে নিয়ে। নানা সময় তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার।

১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর যখন চট্টগ্রামবাসির আমন্ত্রণে আবুধাবির আল আইন শহরে সফরে যান তখন আমি আল আইন সানাইয়া নামক জায়গায় একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম। উনি আমন্ত্রিত হয়ে আল আইনের সানাইয়া নামক এলাকায় জনাব আব্দুল শুক্কুরের অফিসে যাওয়ার সংবাদ শুনে আমি আমার অফিস থেকে ওখানে টেলিফোন করে সরাসরি তার সাথে কথা বলি এবং চসিক মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানাই। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি আমাকে ওনার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অংশগ্রহণ করার জন্য দাওয়াত দেন। তবে  আমার অফিসে জরুরী কাজ থাকায ইচ্ছে থাকার পরও ওনার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারিনি। পরের দিন তার বক্তব্য  পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উনি বলেছিলেন, চট্টগ্রামকে healthy city ও দুবাই জেবল আলী Free port এর মত চট্টগ্রামকেও Free port করার মত ওনার পরিকল্পনা আছে। আমি ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে, আবুধাবী থেকে চট্টগ্রামে আসার পর একটি বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করি। সে সময় চশমা হিলে বসবাস শুরু করি। সংগতকারণে মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রতিবেশী হিসেবে প্রায়ই দেখা হতো। বিশেষ করে জুমার নামাজের পর দেখা হলে প্রায় সময় বাসায় নিয়ে যেতেন। দুপুরের খাবারের পরই ওনার বাসা থেকে আসার অনুমতি পেতাম। মাঝে মাঝে বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়ন পর্ষদের সভাপতি এসএম সিরাজউদ্দৌলা এবং মসজিদের ঈমাম সাহেবও সঙ্গে থাকতেন।

২০০২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আমার কোম্পানীর চেয়ারম্যান ডেভিড ইয়ং ও ইউনি গ্রুফের পরিচালক এলেনটোসহ আমি সিটি কর্পোরেশন অফিসে অনুষ্ঠিত এক অফিসিয়াল মিটিংয়ে যোগ দিয়েছিলাম। সে মিটিংয়ে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ হয়। টপহিম হংকং লিমিটেডের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামে কৃষি ও মৎস্যখাতে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী তার সে আগ্রহকে স্বাগত জানান। তবে নির্বাচিত স্থান ঠা-াছড়িতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উপযোগী না হওয়ায় কোম্পানি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে আমার ও আমার কোম্পানির সম্পর্ক অটুট থাকে। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন।  ১৯৯৪ সাল হতে ২০১৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর আমি একজন প্রতিবেশী ও চশমা পাহাড় আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হিসেবে ওনাকে খুবই কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। ওনার সাথে একান্তে সময় কাটিয়েছি। তারমতো জনদরদী নেতা আমার চোখে তেমন দেখিনি। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সকলের নেতা ছিলেন। যদিও দলগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। কিন্তু মঞ্চের বাইরে তিনি চট্টগ্রামবাসীর নেতা ছিলেন। উনি বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। উনি সাহসী একজন বীরপুরুষ ছিলেন। উনার কাছে ধনী-গরীব সবাই যেতে পারতেন। ওনার বাসায় রোজ গরীব-দুঃখী মানুষের জন্য খাওয়ার আয়োজন ছিল। কখনও তিনি কারো সাথে রাগ করে কথা বললেও তাকে বাসা থেকে না খেয়ে যেতে দিতেন না। তিনি হাফেজ ও মসজিদের ইমাম মাওলানাদের যথেষ্ট সম্মান দিতেন। শিক্ষকদের প্রতি তার যথেষ্ট মূল্যায়ন ছিল। শিশু ও নারীদেরকে স্নেহ ও সম্মান দেখাতেন। গুনীদের কদর করতেন।

একদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম আমাকে নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় যান। উনি তখন আমাদের সাবেক গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমিনসহ সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। কিন্তু ড. জামাল নজরুল ইসলামকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বৈঠক থেকে উঠে যান। স্যারকে সময় দেন এবং আপ্যায়ন করেন। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন সবসময়। সরকার থেকে টাকা না নিয়ে নিজস্ব প্রকল্প থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়ন করার চিন্তা করতেন। ১৭ বছর মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। তিনি চট্টগ্রামকে ভালোবাসতেন। তাই চট্টগ্রামের মানুষ তাকে ভালোবাসতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সৈনিক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামকে এতো ভালোবাসতেন যে, জীবনের শেষমুহূর্তেও সিংগাপুর থেকে আসার পর চট্টগ্রামে নিয়ে আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি ২০১৭ সালের ১৫ ডিসম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে চির বিদায় নেন। লালদীঘি ময়দানে তার জানাজার নামাজে জনতার ঢল নেমেছিল। তার জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে তিনি কতো জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।

লেখক: কাজী গোলাপ রহমান অর্থসম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট