চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ত্রিপুরায় ৫ বীর শহীদের সমাধি

নিজাম উদ্দিন লাভলু, রামগড়

১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:২৮ অপরাহ্ণ

ভারতের উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগর মহকুমার কদমতলা ব্লকের চল্লিশ দ্রোন নামক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি কবরস্থানে সন্ধান মিলেছে লেফটেন্যান্ট এস এম ইমদাদুল হক বীর উত্তমসহ পাঁচজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধির। অযত্ন অবহেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের শহীদ সূর্য সন্তানদের এ সমাধিগুলো। এদিকে শহীদ ইমদাদুলের বয়োবৃদ্ধ ভাই মুক্তিযোদ্ধা এসএম তাবিবুর রহমান (৭০) মৃত্যুর আগে শহীদ ভাইয়ের কবর জন্মভূমি গোপালগঞ্জের মাটিতে দেখে যাওয়ার আকাক্সক্ষার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটা আমার প্রাণের দাবি।’

চল্লিশ দ্রোন গ্রামের বড় কবরস্থানে এই বীর শহীদদের সমাধির সন্ধান পান এ গ্রামের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক আব্দুল ছবুর (৬০)। তাঁর সাথে মুঠোফোনে কথা হয় পূর্বকোণ প্রতিনিধির। ১৯৭১ সালে ১১ বছর বয়সে ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন আব্দুল ছবুর। তিনি বলেন, চল্লিশ দ্রোন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে ঐ ক্যাম্পে যেতেন তিনি। ক্যাম্পেই পরিচয় হয় ইমদাদুল স্যারের সাথে। কখনও কখনও  অংক কষাতেন, বইয়ের পড়াও দেখাতেন। শেষ দেখার দিন তিনি বলেছিলেন, ‘অপারেশনে যাব, কয়েকদিন ক্যাম্পে এসো না।’ ৪-৫ দিন পর ক্যাম্পে গিয়ে জানতে পারি ইমদাদুল স্যার যুদ্ধে মারা গেছেন।

তিনি জানান, চল্লিশ দ্রোন গ্রামের বড় কবরস্থানের পাশে লম্বাটিলা নামক স্থানে লেফটেন্যান্ট ইমদাদুলসহ আরও চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল সালাম নামে একজন ইমাম এ নামাজ পড়ান। পরে বড় কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর পাকা করা হয়। তিনি জানান, কেউ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় কবরের প্রাচীর ভেঙে গেছে। ৫টি কবরের মধ্যে দুটি সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়ায় তাদের নাম পরিচয় হারিয়ে গেছে। এখন ধ্বংসের শেষপ্রান্তের তিনটি কবরের মধ্যে শহীদ ইমদাদুল হক ছাড়াও সমাধির ফলকে লেখা অপর দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ঠিকানা হচ্ছে সিপাই মোকসেদ আলী, রেজি. নম্বর ৩৯৪০০৮৮, বাড়ি কুমিল্লা জেলার গোয়াল পাড়ার কিসমত নোয়াপাড়া গ্রাম। তিনি শহীদ হন ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর এবং মো. জামাল উদ্দিন, রেজি. নম্বর ৩৯৫০০১৭, বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানার বিজয়নগরের পারাবন গ্রামে। তিনি শহীদ হন ১৭ অক্টোবর ১৯৭১। লেফটেন্যান্ট ইমদাদুল হকসহ এ দুজনও ৮ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। শিক্ষক আব্দুল ছবুর বলেন, এক্ষুনি সমাধিগুলো সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া না হলে অচিরেই এগুলো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, দেশের জন্য আত্মবলিদানকারী এসব শহীদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

এদিকে গোপালগঞ্জ সদরের মধুমতি নদীর তীরবর্তী মাটলা গ্রামের বাসিন্দা শহীদ লেফটেন্যান্ট এসএম ইমদাদুল হকের সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম তাবিবুর রহমান বলেন, বড়ভাই ইমদাদুল পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে পরিবারের সাথে দেখা না করেই  ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথমে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টর এলাকায়। পরে জেড ফোর্সের অধীনে সিলেট অঞ্চলে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের ক্যাম্প থেকে ১০০ জনের মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ নিয়ে মৌলভীবাজারের ধামাই চা বাগানে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। প্রচ- এ যুদ্ধে শহীদ হন অসীম সাহসী ইমদাদুলসহ তার অপর দুই সহযোদ্ধা। পরে সহযোদ্ধারা তাদের মরদেহ উদ্ধার করে ভারতের ত্রিপুরায়  সমাহিত করেন।

তাবিবুর রহমান আরও বলেন, দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধে ইমদাদুল শহীদ হওয়ার কথা জানতে পারেন তারা। শহীদ  ইমদাদুল ছাড়াও  পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ও তাঁর আরেক ভাই ইনামুল কবির মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি ছাড়া বাবা-মা ভাই বোন কেউ বেঁচে নেই। শহীদ ইমদাদুলের কবর ভারতের ত্রিপুরা থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা তাবিবুর বলেন, ‘আমার মৃত্যুর আগে গোপালগঞ্জের মাটিতে আমার ভাই শহীদ ইমদাদুলের কবর ফিরিয়ে আনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমার প্রাণের দাবি।’

এদিকে, দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান সম্প্রতি ত্রিপুরা সফরে এসে রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে নির্মাণাধীন বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু পরিদর্শনকালে ত্রিপুরায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইমদাদুল হক বীর উত্তমসহ অন্যান্য শহীদ  মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ত্রিপুরার সহকারী হাইকমিশনারকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নিতে বলবেন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট