চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

মা’কে ফাঁকি দিয়ে আধা সের চিড়া-গুড় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বেরিয়ে পড়ি

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার

মা’কে ফাঁকি দিয়ে আধা সের চিড়া-গুড় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বেরিয়ে পড়ি

কে. জি. ইসলাম

১২ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১২:৩৪ অপরাহ্ণ

সালটা ১৯৭১। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আমার চিত্তকে প্রবলভাবে আলোড়িত ও উজ্জীবিত করে। মার্চের ২৫ থেকে শুরু হল নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক আক্রমণ।

মনস্থির করি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আগস্টের মাঝামাঝিতে নিজেকে শারিরীক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করে ফেললাম। তখন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া রাজারহাট ফরেস্ট অফিসে বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবকরা এসে জড়ো হচ্ছে এবং ভারতে পাড়ি দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। এদিকে, পরিবারে আমার মা এবং অন্যান্যরা কড়া নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে আমার ওপর। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম পালাবার।

একদিন দুপুর বেলা ২টা কি আড়ইটা, একটি ছোট্ট ব্যাগে লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্টের সাথে আধা সের চিড়া ও গুড় এবং বাবার দেয়া একটি হাতঘড়ি নিয়ে বেরিয়ে পদুয়া ফরেস্ট অফিসে পৌঁছলাম। একদিন বিকেল বেলা ৩০-৩৫ জনের একটি দল পার্বত্য রাজস্থলী উপজেলার শ্বাপদ সংকুলান পাহাড়ি পথে দিনরাত পায়ে হেঁটে দীর্ঘ ১২ দিন পর ভারতের মিজোরাম প্রদেশের দেমাগ্রী পৌঁছলাম।

মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার জানান, দেমাগ্রী শরণার্থী ক্যাম্পে কিছুদিন অনাহারে অর্ধাহারে অতিবাহিত করার পর ঘোষণা করা হল প্রশিক্ষণের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক যুবক রিক্রুট করা হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোক উপস্থিত হওয়ায় শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হল। পরীক্ষার বিষয় হল সাঁতরে খরস্রোতা কর্ণফুলি নদী পারাপার এবং ১৫ মিনিটে দুই মাইল দৌড়ানো। এতে যারা সফল হয়েছে তাদেরকেই নেয়া হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। শুরু হল নিয়মিত হাড় ভাঙা ট্রেনিং। ভোর সাড়ে চারটায় হুইশেলের শব্দ শুনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে মাঠে হাজির হওয়া, জগিং এবং মুক্ত হস্তে ব্যায়াম। প্রাতঃরাশ পর্ব সেরে মাঠে চলে কুচকাওয়াজ এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণ। অস্ত্রের মধ্যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, গ্রেনেড, এসএলআর, এলএমজি বিস্ফোরক ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, ভারতীয় প্রশিক্ষক বা কোন কর্মকর্তার কাছে কোন অভাব অভিযোগ নিয়ে গেলে তাঁদের একটাই জবাব ছিল “পয়দা করো”। নিজেরাই সমাধান খুঁজে বের করতাম। সবচেয়ে কষ্টকর কাজ ছিল পানীয় জল সংগ্রহ করা। পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে প্রায় ৫০০ ফুট উপরে ক্যাম্পে তোলা অত্যন্ত দুরূহ ছিল।

মাসাধিককাল ট্রেনিংযের পর নির্দেশ আসল আগরতলা যাওয়ার। পার্বত্য উঁচু নিচু পথ পাড়ি দিয়ে শিলচর হয়ে আগরতলার বগাপাহাড় ক্যাম্পে পৌঁছাই আমরা। সেখানে কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর হরিনা ট্রানজিট ক্যাম্পে আসি। হরিনাতে আমাদেরকে অস্ত্র দেয়া হয়। আমাকে দেয়া হয় ১টি এসএলআর, গুলি এবং কিছু গ্রেনেড। বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে আমাদের দলের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন খোদা বক্স চৌধুরী।

রামগড় সীমান্ত দিয়ে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজানের পাহাড়ি পথ ধরে আমরা রাঙ্গুনিয়ায় চলে আসি। আসার পথে ফটিকছড়ির নারায়নহাট সংলগ্ন যোইগ্যাছোলা পাহাড়ে আমাদের দল পাকিস্তানি আর্মিদের এম্বুসের রেঞ্জে পড়ে গিয়েছিল। একজন পাহাড়ি উপজাতীয় ছেলে কিছু আগে আমাদের খবর বলাতে আমরা বেঁচে যাই। রাঙ্গুনিয়া এসে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া পুলিশের সাবেক এআইজি (অব.) নুরুল আলম এবং ছালেহ আহমদের গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হই। এই মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার খোদা বক্স চৌধুরী ও ডেপুটি কমান্ডার আহমদুল হকের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়ক ও চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি সড়কে পাকিস্তানি সেনাদের অবাধ চলাচল ও রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে বাধা সৃষ্টিতে সাহসী ভুমিকা রাখেন। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে বিদ্যুতের টাওয়ার ধ্বংস, সরফভাটার চিরিঙ্গা পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে কর্ণফুলি নদী পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলের সময় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিত তালুকদার রাঙ্গুনিয়া স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে ১৯৮৪ সালে যোগ দেন কর্ণফুলি পেপার মিল (কেপিএম) স্কুলে শিক্ষকতা পেশায়। ৩১ বছর শিক্ষকতা করে অবসর নেন যুদ্ধে জয়ী মানুষ গড়ার কারিগর প্রসেনজিত তালুকদার।

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট