চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

যৌবন ফিরে পেয়েছে ফিশারিঘাট বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ জুন, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

ভোরের হালকা আলোয় পাথরঘাটার ফিশারিঘাটমুখী রাস্তাগুলো এর মধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেটে অর্ধেক করা ড্রাম আর ঝুড়ি নিয়ে ছুটছে রিকশা-ভ্যান, পিকআপ আর ট্রাক। ইকবাল রোড বেয়ে একটু সামনে যেতেই নাকে এলো মাছের গন্ধ। কয়েকটি মাছের ঝুড়ি রাখা হয়েছে রাস্তায়। তবে জেগে আছে মাছের সব আড়তগুলো। রাস্তায় বরফের চাই ভেঙ্গে চলছে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের আগাম প্রস্তুতি। একটু পরই ওই চত্বর আর গোটা রোড জুড়ে জমে উঠবে দেশের অন্যতম বৃহৎ কাঁচা মাছের বাজার। ২২ মাস পর বাজারটিতে ফের বেচাকেনা শুরু হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা শুরু করেন।
দেশে একই সঙ্গে মিঠা ও নোনা পানির এমন মাছের বাজার এই একটিই। হেন মাছ নেই যা পাওয়া যায় না এই বাজারে। কর্ণফুলী নদীর তীরে চাক্তাই-রাজাখালী খালের মোহনায় নতুন মাছ বাজার নির্মাণের পর দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন মাছ ব্যবসায়ীরা। বাজার পেরিয়ে নদীর তীরে আসতেই ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। তীর ছুঁয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর গড়ে উঠেছে মেরিন ড্রাইভ রোড। এরপর আরো শ’দুয়েক মিটার নদী হাওয়া ইট বাঁধানো চত্বরে। ঘাটে বাঁধা সারি সারি ফিশিং বোট আর ট্রলার। একটার পর আর একটা। কয়েক সারি বোটের ওপাশে অনেক সরু দেখাচ্ছে কর্ণফুলীকে। ইট বাঁধানো বিশাল চত্বরে নানা আকৃতি আর রঙের জাল বিছানো। ডানে বঙ্গোপসাগরের দিকে ফিরিঙ্গিবাজারের ওপাশে একটা একটা করে নিভতে শুরু করলো বন্দরের আলো।
বোটগুলো থেকে একটা একটা করে নামতে শুরু করলো ঝাঁকাভর্তি মাছ। কিছু সময়ের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো পুরো ফিশারিঘাট এলাকা। নিষিদ্ধ পটকা মাছের ঝাঁকাও দেখা গেলো ক’টা। চোখে পড়লো নোনা পানির শাপলা পাতা মাছও। মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে সকালেই ক্রেতা-বিক্রেতার গিজগিজে ভিড়। ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর আর খুলনা থেকে আসা মিঠা পানির মাছেও সয়লাব বাজার। একই প্রজাতির কৈ, কোরাল আর লাল কোরালের কদরও আছে বেশ। আছে রূপচাঁদা, টেকচাঁদা, কালাচাঁদা। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে এই বাজারে আরো আছে শাপলা পাতা মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ, লাক্ষ্যা, কেচকি, ফাইস্যা, রাঙা চইটকা, মাইট্যা, ছুরি, বোম, বাইন, গুয়াকাটা, তাইল্ল্যা, লইট্যা, বাইল্যা, পোয়া, গাঙ কৈ, যাত্রিক, সুরমা, চাপিলা, চেউয়া, লাল কাপিলা, কালো কাপিলা ইত্যাদি আরো অনেক প্রজাতি। মিঠা পানির মাছের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী আর চাষের রুই, কাতলা, সরপুঁটি, শিং, মাগুর, কৈ, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিনার কার্প, বিগ্রেড, মৃগেল, ভেটকি, বাটা, নাইলোটিকা, বাগদা চিংড়ি, ইছা চিংড়ি, টাকি, মলা, দেশি পুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, আইড়, বাইন, তারাবাইন, পিয়া, কাতাল, কালবাউশ, বোয়াল, চিতল, ইলিশ, বাঘাইর, বাইল্যা ইত্যাদি আরো অনেক প্রজাতি।
ব্যবসায়ীরা জানান, ফিশারিঘাটে প্রতিদিন অন্তত কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। ফিশারিঘাট থেকে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় মাছ সরবরাহ করা হয়। শতাধিক মেট্টিক টন মাছ বিক্রি হয় প্রতিদিন। এই ফিশারিঘাটের ঐতিহ্য প্রায় ২শ’ বছরের পুরনো। ১৬ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা আসে চট্টগ্রামে। ১৫৩৭ সালে শের শাহ’র আক্রমণে ভীত হয়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে তাদের বাণিজ্য কুঠি ও চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার দেন। পর্তুগিজরা এখানে আড়ৎ স্থাপন করেন। তাদের নামানুসারে এলাকাটি পরিচিতি পায় ফিরিঙ্গিবাজার নামে। সেই বাজারের অদূরে গড়ে ওঠে মাছ বা ফিশ এর কয়েকটি ল্যান্ডিং স্টেশন। সবচেয়ে বড় ল্যান্ডিং স্টেশনটি পরিচিতি পায় ফিশারিঘাট নামে। ঐতিহ্যের দিক থেকেও তাই এ বাজারের গুরুত্ব অনেক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট