চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অদম্য ইচ্ছেশক্তির কাছে হার মানে পাক সেনারা

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর ফারুকী

অদম্য ইচ্ছেশক্তির কাছে হার মানে পাক সেনারা

সেকান্দর আলম বাবর 

৮ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১:১১ অপরাহ্ণ

১৯৭১-এ ১৮ বছরের টগবগে যুবক যুদ্ধজয়ী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর ফারুকী। উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নের হাজী জেবল হোসেন প্রেসিডেন্টের বাড়ির ফজলুর রহমান ও ছবিলা খাতুনের ৮ পুত্র ও ৫ কন্যার মধ্যে সপ্তম তিনি। সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আবুল বশর ফারুকী। তিনি যুদ্ধকালীন ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে বেশিরভাগ সময় বোয়ালখালীর কমান্ডার মোহাম্মদ সোলায়মান বিএসসি’র নেতৃত্বে, কখনও কোম্পানি কমান্ডার এমএ বশর, কখনও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও কীর্তিগাথা নিয়ে পূর্বকোণের সাথে কমান্ডার আবুল বশর ফারুকীর কথা হয়। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ সকালের খবরে শুনলাম পাকিস্তানিরা ঢাকা আক্রমণ করেছে। এলাকার অনেকের কাছে শুনলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সৈন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে বোয়ালখালী এসে অবস্থান নিয়েছে। আমি ওইসময় থেকে ছটফট করি কীভাবে তাদের সাথে কথা বলা যায়। আর্মিরা মার্চের ২৮ তারিখ থেকে পরবর্তী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় বাংকার করে বোয়ালখালীকে সুরক্ষিত রাখে। ক্যাম্প করা হয় বহদ্দারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আর্মির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন হারুন, লে. শমশের মোবিন চৌধুরীসহ নাম না জানা কয়েকজন। কালুরঘাটে বাংকারে প্রায় প্রতিদিনই আমি খাবার নিয়ে গেছি আ. লীগের সংগঠক আতাউল হকের পক্ষ থেকে।

ইতোমধ্যে এলাকার কিছু মুক্তিপাগলের সাথে আমার সখ্য হয়। সবার নেতা ছিলেন কমান্ডার সোলায়মান বিএসসি। অন্যান্যরা হলেন এস এম ওয়াজেদ, রেজাউল করিম আরবী বেবি, ওস্তাদ ফজলু, আবদুল কাদের, রহমত আলী, বড় শামসু, গুড়া শামসু প্রমুখ। দলে আরও যুক্ত হন হারেছ আহমদ, আবু মিয়া ড্রাইভার, কালু মিয়া, মোহাম্মদ শফি, ওসমান গনি, জালাল আহমদ, আবদুল গফুর মেম্বার, আবু মিয়া, আবদুল মজিদ, আবুল মনসুর, নুরুল আমিনসহ মোট ১৬ জন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা এলাকায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তিনি আমাদের ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য নিয়ে যান সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে।

অপারেশন থানা হেডকোয়ার্টার: বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর ফারুকী বলেন, আমার যুদ্ধজীবনের সেরা যুদ্ধ ২৮ আগস্ট রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনাদের বোয়ালখালীর মূল ক্যাম্প থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণে অংশগ্রহণ। আমরা প্রথমে সংগঠিত হয়েছিলাম জ্যৈষ্ঠপুরা সেনের বাড়িতে। অপারেশন কমান্ডার ছিলেন সোলায়মান বিএসসি। এতে দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। আমরা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়েছিলাম। আমি ফাইটিং গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিলাম। ভোর ৪টার দিকে অপারেশন শেষ হয়। মূলত থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণের পরে বোয়ালখালীতে পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকারদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়।

অপারেশন কর্ণফূলী: আগস্টের শেষের দিকে কর্ণফুলীতে পাক হানাদারদের আক্রমণে অংশ নেই প্লাটুন কমান্ডার এমএ বশরের নেতৃত্বে। এতে আমি, ব্যাংকার মান্নান, গুরা শামসু, লাল মোহাম্মদ, সেলিম চৌধুরী, নাছের, ভোলা মিয়া, আবদুল লতিফ, রাজা মিয়া, রনজিত দাশ, রনজিত বড়–য়াসহ অন্তত ১৫ জন অংশগ্রহণ করি। পাক সেনারা নদীপথে চন্দ্রঘোনা যাওয়ার পথে আমরা ফখিরাখালী থেকে আক্রমণ করি। আধঘণ্টার এ যুদ্ধে কয়েকজন পাক সেনা হতাহত হয়। তারাও পাল্টা গুলি করে। আমরা কৌশলী ছিলাম, তাই আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। এ যুদ্ধে আমাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়।

অপারেশন শুক্কুরছড়ি: অক্টোবরে কাপ্তাইয়ের শুক্কুরছড়ি নামক স্থানে পাক আর্মির সাথে যুদ্ধ হয়। আমরা সংখ্যায় ৪০ জন ছিলাম পাহাড়ী জঙ্গলে, পাকিরা তিনটি স্টিমারে ছিল নদীতে। প্রচ- গোলাগুলি। তিন ঘণ্টার যুদ্ধে এক পর্যায়ে দুটি স্টিমার ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই। এতে আমাদেরও সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। নেতৃত্বে ছিলেন এস এম ইউছুফ, রবি চেয়ারম্যান, মাহবুবুল আলম, আবদুল ছবুর প্রমুখ।

অপারেশন বিলাইছড়ি: নভেম্বরের শুরুতে ফের রাঙামাটির বিলাইছড়িতে নদীতে পাক সেনাদের স্টিমারে আক্রমণ করি। আমরা সংখ্যায় এবারও ৪০ জন, পাকিস্তানিরা ৮০ জন। এতে অন্তত ৫০ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে আমি পায়ে গুলিবিদ্ধ হই। আমাদের অন্তত ১০ জন গুরুতর আহত হন।

কী পেয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর ফারুকী বলেন, দেশকে কী দিয়েছি সেটাই প্রশ্ন। যুদ্ধ করে ত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভূমিকে রক্ষা করেছি, পারিনি পিতাকে রক্ষা করতে। এটা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের চরম ব্যর্থতা।

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট