চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

নগর পরিবহনে ছয় কারণে ফিরছে না শৃঙ্খলা

নাজিম মুহাম্মদ 

৩ ডিসেম্বর, ২০২০ | ১:০৭ অপরাহ্ণ

নগরীতে রুট পারমিট অনুযায়ী যানবাহন চলাচল না করা, বছরের পর বছর ধরে সড়কে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচল, পারমিট ছাড়া যানবাহন চলাচলসহ ছয় কারণে নগর পরিবহনের শৃঙ্খলা কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না। এছাড়াও অন্য তিন কারণ হল ভিন্ন ভিন্ন গতির গাড়ি একই রাস্তায় চলাচল করা, আশংকাজনক হারে রিকশা বেড়ে যাওয়া এবং আরটিসির (রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়া। নগর পরিবহনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে আলাপ করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। নগর পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ (আরটিসি)’র তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস-মিনিবাসের রুট রয়েছে ১৬টি। একইভাবে হিউম্যান হলারের ১৮টি ও অটোটেম্পোর রুট রয়েছে ২১টি।

গাড়ির মালিক মানছে না রুট পারমিট

চলতি বছরের ২১ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত আরটিসির সভার তথ্য অনুযায়ী নগরীর ১৮ রুটে বাস ১,৫৪৫টি বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমোদন দেয়া হলেও ১,০৪০টি গাড়ি চলাচল করছে। আরো ৫০৫টি বাস-মিনিবাস চলাচল করতে পারবে রুটগুলোতে। এরমধ্যে নতুন করে ২৬৩টি বাস-মিনিবাস এসব রুটে চলাচলের জন্য আবেদন করেছে। পারমিট বাতিল করা হয়েছে ৩৪ বাস-মিনিবাসের।

একইভাবে নগরীতে অটোটেম্পার রুট রয়েছে ২১টি। রুটগুলোতে ২৩৯৭টি গাড়ি চলাচলের অনুমতি দিয়েছে আরটিসি। সেখানে রুট পারমিট নিয়েছে ১,৮৩৯টি। আরো ৫৫৮টি  অটোটেম্পার রুট পারমিট  নেয়ার সুযোগ রয়েছে। নতুন করে ৫১৩টি গাড়ি পারমিটের জন্য আবেদন করেছে। যথাসময়ে রুট পারমিট  না নেয়ায় ৫৭টি টেম্পোর পারমিট বাতিল করেছে আরটিসি।

১৮টি রুটে ১,৪৫৬টি হিউম্যান হলার চলাচলের রুট পারমিট অনুমোদন দিয়েছে আরটিসি। সেখানে চলাচল করছে ৯৯৪টি। আরো ৪৬২টি হিউম্যান হলার পারমিট নিতে পারবে। তবে ৬৯৩টি হিউম্যান হলার নতুন করে পারমিটের আবেদন করেছে। ১২টি গাড়ির পারমিট বাতিল করা হয়েছে। এর বাইরেও প্রায় ২০০ বাস-মিনিবাস এবং ৮শ’র বেশি  হিউম্যান হলার ও টেম্পো নগরীর বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে।

প্রতিটি রুটে পারমিট খালি থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। অনুমতিপ্রাপ্ত রুটগুলোতে যানবাহন চলাচলের নিয়ম মানে না অনেক গাড়ির মালিক। যানবাহন মালিক সমিতির নেতারা ভুল তথ্য সম্বলিত সমিতির স্টিকার গাড়ির সামনে লাগিয়ে যে রুটে বেশি যাত্রী সেই রুটেই গাড়ি চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

আরটিসির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীরগতি

নিয়ম অনুযায়ী ৪৫ দিন পর পর আরটিসির  (রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি)  বৈঠক হবার কথা থাকলেও গত দুই বছরে অর্থাৎ ২০১৯ ও ২০২০ সালে আরটিসির মাত্র দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিয়ম না মানায় যথাসময়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাই ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া আরটিসির সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা, যথাযথভাবে সেই তদারকি হচ্ছে না। যেমন, ২০১৮ সালের আরটিসির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো, ২০ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে এমন টেম্পো, হিউম্যান হলার কিংবা ২৫ বছরের বেশী অতিবাহিত হয়েছে এমন বাস মিনিবাস নগরী থেকে অপসারণ করা হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, মেয়াদোত্তীর্ণ এসব গাড়ি ঠিকই বছরের পর বছর চলাচল করছে নগরীতে। কথা ছিলো, সিএনজিচালিত গ্রাম ট্যাক্সিগুলোর সামনের অংশে হলুদ রং এবং পেছনে সবুজ রং থাকবে। যাতে মেট্টো এলাকায় এসব  ট্যাক্সি প্রবেশ করলে সহজেই ধরা পড়ে। বাস্তবে তা করা হয়নি। নগরীর লালখান বাজার কিংবা ফৌজদারহাট বাইপাস এলাকায় গ্রাম ট্যাক্সি চলাচল করছে নির্বিঘেœ। এসব ট্যাক্সিতে ঘটছে নানা অপরাধ।

প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া

সড়ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, নগর পরিবহন ব্যবস্থা শৃঙ্খলায় আনতে পরিবহন মালিকরা আন্তরিক নয়। আমি নগর পরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের (রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সংক্ষেপে আরটিএ) মেম্বার ছিলাম তিন বছর। আরটিএ সভায় অনেকে অনেক সুন্দর পরামর্শ দেন। কিছু সিদ্ধান্ত নেয়াও হয়। তবে বাস্তবায়ন তেমন হয় না। যেমন- আরটিএ’র সভায় জিইসি মোড়ে ট্রাফিক ম্যানজেমেন্টের জন্য একবার পরিকল্পিত একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে দেখা গেলো যারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে তারাই আসেনি। স্বেচ্ছায়  আরটিএ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। কারণ যেখানে সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না সেখানে গিয়ে কোনো লাভ নেই।

সুভাষ বড়ুয়া বলেন, একই সড়কে বিভিন্ন গতির গাড়ি চলাচল, এক রুটের গাড়ি অন্য রুটে চলাচল, রুট পারমিট ক্ষেত্রবিশেষে কোনো ধরনের পারমিট ছাড়া যানবাহন চলাচল- এসব বিষয় সুশৃঙ্খল নগর পরিবহন ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। একশ’ মালিক না থেকে কোম্পানি ফরমেটে বাস পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সবাই এক কাতারে চলছে। কোনো ম্যানেজমেন্ট নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও অনেকটা ঢিলেঢালা। সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দেয়ার লোকের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবায়নে কেউ থাকে না।

ট্রাফিকের দুই ডিসি’র বক্তব্য

নগর ট্র্রফিকের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, ২০ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে এমন টেম্পো কিংবা হিউম্যান হলার পাওয়া গেলে জব্দ করছে ট্রাফিক বিভাগ। অনেক সময় দেখা যায়,  বিআরটিএ’র  ফিটনেস  সার্টিফিকেট পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে আমাদের করার কিছুই থাকে না। সাম্প্রতিক সময়ে নিলামে কিছু সিএনজিচালিত ট্যাক্সি কিনে নিচ্ছে অনেকে। এসব ট্যাক্সির কোন রুট পারমিটই নেই। তবে আদালতের আদেশের কপি থাকায় এসব ট্যাক্সির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।

ট্রাফিকের বন্দর জোনের উপ-কমিশনার তারেক আহম্মেদ জানান, রুট পারমিট ছাড়া গাড়ি পাওয়া গেলে মামলা দেয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বাস-মিনিবাস পাওয়া যায় যেগুলোর রং উঠে গেছে। দেখে মনে হয় মেয়াদোত্তীর্ণ। কাগজপত্রে হাতে নিলে দেখা যায়, বিআরটিএর ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। কিছু বাস আছে যেগুলো আরটিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ। আরটিসির  অনুমতিক্রমে এসব গাড়ি বিভিন্ন গার্মেন্টসে কর্মী বহন করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তারপরও এসব গাড়ির বিষয় এবারের আরটিসির সভায় তোলা হবে।

সড়কের যানবাহনের বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন  পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, নগরীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো খুবই জরুরি। সড়কে যানবাহনের বিশৃঙ্খলার জন্য মালিক সমিতিগুলোও কম দায়ী নয়। এক রুটে পারমিট নিয়ে অন্য রুটে গাড়ি চালায়। কিছু রুটে অনুমোদনের দুই-তিনগুণ বেশি গাড়ি চলাচল করছে। যেখানে যাত্রী বেশি সেখানে গাড়ি বেশি ছুটছে। রিকশার  নিয়ন্ত্রণ নেই।  তবে যথাসময়ে আরটিসির সভা অনুষ্ঠিত হলে অনেক সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকরের পাশাপাশি নতুন নতুন সমস্যা চিহ্নিত করা সম্ভব হতো বলে জানান তিনি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট