চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

‘পুলিশের সখ্যে’ দায়মুক্তি দুই ইয়াবা গডফাদারের

নাজিম মুহাম্মদ

১৩ জুন, ২০১৯ | ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিলেও কিছু পুলিশ কর্মকর্তার সাথে সখ্যের কারণে ইয়াবা পাচারের হোতারা দায়মুক্তির সুবিধা নিচ্ছে। যার কারণে ইয়াবা বহনকারীরা আইনের আওতায় আসলেও মূল পাচারকারীরা থেকে যাচ্ছে বরাবরই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ও স্বীকৃত দুই ইয়াবা পাচারকারী ধরা পড়ার পরও তদন্ত প্রতিবেদন থেকে তাদের বাদ দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেয়া দুটি মামালার বাদিও পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে সখ্য গড়ে তুলে আর্থিক সুবিধা নিয়ে দুই ইয়াবা পাচারকারীকে তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। পুলিশের সহায়তায় তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ যাওয়া এ দুই ইয়াবা পাচারকারী হলেন টেকনাফের ডেইল পাড়ার আবদুল আমিন ও রোহিঙ্গা রেজওয়ান ওরফে রেদোয়ান ওরফে জুবায়ের। আবদুল আমিনের বড় ভাই মোহাম্মদ আমিনও তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারী। আমিন সহোদর গত ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফে পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন। জুবায়ের ইয়াবা পাচারের অভিযোগে বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। আব্দুল আমিন ও তার ভাই মোহাম্মদ আমিন দু’জনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী এবং সম্প্রতি পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত

ইয়াবা গডফাদার হাজী সাইফুল করিমের ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম অংশীদার। পূর্বকোণের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের ৪ মে হালিশহর শ্যামলী আবাসিক এলাকা থেকে তেরো লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে যে, আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচারকারী রহিম মিয়ানমার থেকে সাগর পথে এ বিপুল পরিমাণ ইয়াবা পাঠিয়েছিলেন। রহিম বাংলাদেশে আসলে নগরীর বায়েজিদ থানার মোজাফফর নগরে রোহিঙ্গা রেজওয়ান ওরফে রেদোয়ান ওরফে জুবায়েরের বিলাসবহুল ভবনে থাকতেন। জুবায়ের নিজেও একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী।
ঘটনার পর পরই আত্মগোপনে যাওয়া রেদোয়ান ছয়মাস পর ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর মালেশিয়া পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন।
ঘটনা-১: গত বছরের ৬ অক্টোবর কুয়াইশ-অক্সিজেন রোড এলাকা থেকে সাত হাজার ৭৫০ পিস ইয়াবাসহ আবদুল গফুর নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। গফুরের বাড়ি উখিয়ার পালংখালিতে। এ ঘটনায় এস আই ফরিদ আহমেদ বাদি হয়ে ঐ দিনই (৬ অক্টোবর ২০১৮) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গ্রেপ্তার গফুর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন যে রামুর মীর কাশেমের কাছ থেকে তিনি ইয়াবাগুলো এনেছেন। গফুরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রামুর মীর কাশেম, টেকনাফের মো. শরীফ ও তেরো লাখ ইয়াবা পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার রেজোয়ানকে আসামি করা হয়। কাশেম ও শরীফকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি রেজোয়ানকে একদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাবাদও করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বায়েজিদ থানার এস আই উৎপল চক্রবর্তী।
তদন্ত শেষে কাশেম, শরীফ ও রেজোয়ানকে বাদ দিয়ে গত ৪ মার্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন এস আই উৎপল। প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেন- ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার গফুরের সাথে গ্রেপ্তার হওয়ার ছয়দিন পূর্ব থেকে মোবাইলে কোন কথা হয়নি। গফুর তাদের নাম বললেও তদন্তে ইয়াবা পাচারের সাথে জুবায়ের কিংবা অন্য দুইজনের জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া যায়নি। এতে আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচারকারী দলের সদস্য জুবায়ের একটি ইয়াবা পাচারের মামলা থেকে দায়মুক্তি পেলেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এস আই উৎপল চক্রবর্তী বলেন, রেজোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ডে এনেছিলাম। এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার সত্যতা মেলেনি। তাই চার্জশিট থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
ঘটনা-২: ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যববসায়ী আবদুল আমিনকে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ স্টেশন রোড এলাকার হোটেল প্যারামাউন্টের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করেছিলো নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় আব্দুল আমিনকে এজাহারভুক্ত আসামি করে ঐদিনই কোতোয়ালী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তীতে ওই বছরের ১১ মে মাদক পাচারের অভিযুক্ত থাকার অপরাধে আব্দুল আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশীট) দাখিল করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন। কয়েকমাস কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে ফের ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন আমিন সহোদর।
ঘটনা-৩: দেড় বছরের মাথায় ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর কোতোয়ালী থানার নেভাল একাডেমি এলাকা থেকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা ও একটি প্রাইভেট কারসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুল আমিন ও তার ভাই মোহাম্মদ আমিনকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের এস আই আসাদুজ্জামান টিটু বাদি হয়ে পরদিন ( ৭ সেপ্টেম্বর) কোতোয়ালী থানায় মাদকদ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পর ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর আবদুল আমিনকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মোহাম্মদ আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক কেশব চক্রবর্তী। আবদুল আমিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এবং দেড় বছর আগে ইয়াবাসহ ধরা পড়লেও সেই বিষয়ও রহস্যজনক কারণে তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পূর্ব ইতিহাসের কলামে উল্লেখ করেননি। তদন্ত কর্মকর্তার বদৌলতে ইয়াবা গডফাদার আব্দুল আমিন ইয়াবা পাচার করা সত্ত্বেও আইনের আওতায় আসেননি। অভিজাত এলাকা নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করে রীতিমতো ইয়াবা ব্যবসা করেছেন আমিন। পরিদর্শক কেশব চক্রবর্তী বর্তমানে চন্দনাইশ থানার ওসির দায়িত্ব পালন করছেন।
আদালতে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে নৈশ মোবাইল ডিউটি করাকালে নেভাল একাডেমি এলাকায় চেকপোস্টে একটি খয়েরী রঙের প্রাইভেট কারকে সিগন্যাল দেন গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর ও দক্ষিণ) একটি টিম। কারটি সিগন্যাল অমান্য করে চালিয়ে গেলে গোয়েন্দা পুলিশ পিছু ধাওয়া করে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে চালক প্রাইভেট কারটি কাজীর দেউড়ি গণশৌচাগারের সামনে ফেলে পালানোর চেষ্টা করে। এসময় একজনকে পুলিশ আটক করতে পারলেও আরো দুইজন লোক গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যায়। পরে তল্লাশি করে গাড়ির সিটের নিচে কাভারের ভেতর থেকে পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর তদন্তকালে জানতে পারেন- ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম মো. আমিন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারী। তার বাড়ি টেকনাফ থানার ডেইলপাড়ায়। তার বাবার নাম হাজী মোহাম্মদ আলী ওরফে কালা মিয়া। তিনি নগরীর অভিজাত ও.আর নিজাম আবাসিক এলাকার ৩৮ নম্বর রোজগার্ডেন নামক ভবনের ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়া দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন মোহাম্মদ আমিনের ছোট ভাই আবদুল আমিন। ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া বড়ভাই আমিনের সাথে একই গাড়িতে থাকলেও ঘটনায় তার জড়িত থাকার সত্যতা নেই এমনটি দাবি করে তদন্ত প্রতিবেদন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা পাচারকারি ইয়াবা গডফাদার হাজি সাইফুলের ইয়াবা ব্যবসার পার্টনার আবদুল আমিনকে তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেন তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক কেশব চক্রবর্তী। বছরের পর বছর ধরে নগরীতে ইয়াবা করে কোটিপতি হওয়া আমিন সহোদর অবশেষে গত ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় আতœসমর্পণ করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট