চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রথম ব্যাচের ছাত্রের স্মৃতিতে ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলো

‘তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’

তাসনীম হাসান

১৮ নভেম্বর, ২০২০ | ১:৪৫ অপরাহ্ণ

চুল থেকে দাঁড়ি সবই সফেদ। গায়েও একই রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা। হাঁটাচলায় মন্থর। কানেও শোনেন কম। স্বাভাবিকভাবেই প্রবীণের বয়সটা আঁচ করা যায় খুব সহজেই। এই নভেম্বরের ৫ তারিখেই আশি ছুঁয়েছেন। কিন্তু সেটি কেবল ক্যালেন্ডারের হিসাব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তুলতেই তিনি যেন ত্রিশের তরুণ; এক ঝাপটায় ফিরে গেলেন ষাটের দশকের সেই রঙিন দিনগুলোতে। এই ‘তিনি’ হলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর গর্বের পরিচয় তিনি যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ বুধবার। তার আগেরদিন গতকাল নগরীর প্যারেড কর্নারের বাসায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তিনি খুলে দিলেন স্মৃতিঘরের বদ্ধ দরজা। পাশে বসে পূর্বকোণের সঙ্গে সেই স্মৃতি শুনল তাঁর তিন নাতি-নাতনিও।

১৯৬৬ সালে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি এই চার বিভাগ আর ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই শিক্ষার্থীদের একজন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়েরঅর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন তাও ৫২ বছর আগে, ১৯৬৮ সালে। কিন্তু এখনও তাঁর শরীরের প্রতি কণায় কণায় সেই ক্যাম্পাসজীবনের পুরোনো আবেগের বাস।

এখন তো শাটল আর ডেমুতে করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করেন। তখন কীভাবে যেতেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বুঝিয়ে দিলেন, এই আশি উত্তীর্ণ বয়সেও সেই পুরোনো স্মৃতি ঘোলাটে হওয়ার নয়। তুলে ধরলেন টিনের বাসে ঝুলে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়ার সেই কথা। বললেন, ‘এখন দুই নম্বর গেট নামে যেটির পরিচয় তখন সেটিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বার। হাটহাজারীগামী বাসে চড়ে সেই গেটের মুখে নামতাম। তার জন্য গুনতে হতো চার আনা। সেই গেট থেকে দুই আনায় রিকশায় চেপে সোজা ক্যাম্পাসে। তখন অবশ্য এতো এতো স্থাপনা ছিল না। ক্যাম্পাসও ছিল সীমাবদ্ধ।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী। তখনকার ছাত্র-রাজনীতি আর এখন ছাত্র-রাজনীতির তুলনা করতে গিয়ে সিরাজুল ইসলামের চোখের পর্দায় এক লহমায় ফিরে এলো ১৯৬৬ থেকে ‘৬৮ সাল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সেই সময়েও ক্যাম্পাসে অনেক ছাত্রসংগঠন ছিল। আমাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হতো-তা ঠিক। কিন্তু সেটি শেষ হতেই একসঙ্গে বসে চা-নাশতা খেতাম। প্রতিপক্ষকে খুন করা তো দূরের কথা, মারধর করাও ছিল কল্পনাতীত। আর এখন দেখছি নিজের ভালোলাগার সংগঠন ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই কত গ্রুপ। নিজেরাই নিজেদের কর্মীকে খুন করে ফেলছে কত সহজে। এসব দেখে খুব হৃদয়ক্ষরণ হয় রে।’

শিক্ষকদের কথা বলতেও ভুললেন না মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বলেন, তখনকার শিক্ষকেরাও ছিলেন অকৃপণ। যে ছাত্রের মাঝে একটু সম্ভাবনা দেখেছেন, তাঁকে এগিয়ে নিতে তাঁদের সে কি প্রচেষ্টা।

বেশ আমুদে মানুষ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে কাছে পেলেই আড্ডা জুড়ে দেন। যদিও করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে এখন কিছুটা ঘরবন্দী। তাই তাঁর স্মৃতিচারণে ঘুরে-ফিরে আসল বন্ধুদের স্মৃতিও। বলেন, ‘বন্ধুরা মিলে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াতাম। আফসোস, আমি একা পড়ে রইলাম। তাঁরা কেউ আজ বেঁচে নেই।’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে সিরাজুল ইসলামের, চিক চিক করে উঠে চোখের কোণ।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামব নামব করছে। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে সিরাজুল ইসলামের যেন কোনো ক্লান্তি নেই। বিদায়বেলায় তাই বলে উঠলেন, ‘আবার আসবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর সেই দিনগুলো নিয়ে আরও অনেক কথা বাকি আছে।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট