চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বেতনের অর্ধেকই চলে যায় বাসা ভাড়ায়

তাসনীম হাসান 

১৬ নভেম্বর, ২০২০ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

নগরীর পতেঙ্গার জিএম গেট এলাকায় দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে দুই কক্ষের একটি আধাপাকা ঘরে থাকেন পোশাক শ্রমিক জমির উদ্দিন। মাস শেষে চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কারখানায় কাজ করা এই শ্রমিককে বাসা ভাড়া গুনতে হয় ৬ হাজার টাকা। অথচ ওভারটাইমসহ (অতিরিক্ত কাজ) তিনি বেতন পান ১২ হাজার টাকা।

জমির উদ্দিন তাই পূর্বকোণকে আফসোসমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘বেতনের ৫০ শতাংশই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি টাকায় খাই কীভাবে? সন্তানদের কাপড়-চোপড় কিনে দিই কীভাবে।’

বাসা ভাড়া নিয়ে এই দীর্ঘশ্বাস শুধু জমির উদ্দিনের একার নয়, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডের ১৮৭টি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিকের কণ্ঠে যেন একই আকুতি।

দুই ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের বেশিরভাগই যাতায়ত সুবিধার কারণে থাকেন ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায়। তাই চাহিদা থাকায় এসব ওয়ার্ডে আধা-পাকা ঘরের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে অন্য ওয়ার্ডের চেয়ে বেশি। এর ফলে নিম্ম আয়ের শ্রমিকেরা সংসার নিয়ে হিমশিম খান প্রতিনিয়ত। তাদের সেই দীর্ঘশ্বাস শোনারও যেন কেউ নেই।

বাসা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে শ্রমিকেরা বিভিন্ন সময়ে মাঠে নেমেছেন। বিশেষ করে ২০১১ সালে তাঁদের আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর বাসা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম ইপিজেডের শ্রমিকেরা লেবার কলোনি মাঠে সমাবেশের ডাক দেন। পুলিশের বাধায় সমাবেশ করতে না পেরে ওইদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ইপিজেড মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এ সময় ইপিজেড মোড় ও কলসী দিঘি পাড় এলাকায় ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। সড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়ায় বন্ধ হয়ে যায় বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগও।  এই আন্দোলনের রেশ ছিল টানা কয়েকদিন। এরপর বাসা ভাড়া নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয় প্রশাসন। স্থানীয় সাংসদ এম এ লতিফের উদ্যোগে বাসা ভাড়া নিয়ে জরিপ চালাতে ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ১০টি উপকমিটি গঠন করা হয়। প্রশাসনের তোড়জোড়ের কারণে বাসা ভাড়া ভাড়ার প্রবণতা কিছুটা থমকে ছিল। তবে কয়েকমাস যেতে না যেতেই আগের অবস্থানে ফিরে যান বাড়ির মালিকেরা।

সেই কথাই যেন উঠে আসে ৪০ নম্বর পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে কয়েকবার নির্বাচিত কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীনের কণ্ঠে। সাবেক এই কাউন্সিলর পূর্বকোণকে বলেন, ‘২০১১ সালের সেই আন্দোলনের পর বাসা ভাড়া নিয়ে বেশ কিছু কমিটি হলেও তা পরবর্তীতে কার্যকারিতা হারায়। এখন শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নতুন করে কোনো দাবি উঠলে আমরা সমাধানে উদ্যোগী হবো।’

জয়নাল আবেদীন আরও বলেন, শ্রমিকদের কারণে চাহিদা থাকায় নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমের পাঁচটি ওয়ার্ডে বাসা ভাড়া একটু বেশি তা ঠিক। তবে কারণ জানতে চাইলে, বাড়ির মালিকেরা পানির সমস্যা, ঘর নির্মাণ ব্যয় ও গ্যাসের দাম বাড়ার অজুহাত দেখান।

অবশ্য প্রতিবছরের শুরুতে চট্টগ্রাম নগরীতে বাসা ভাড়া বাড়ানো হয়। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি গত ২৫ বছরে চট্টগ্রামে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বাসা ভাড়া। অবশ্য সংগঠনটি ২০১৬ সালের পর চট্টগ্রামে আর জরিপ করেনি। ওই সময় সংগঠনটি জানিয়েছিল, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ হারে চট্টগ্রামে বাসা ভাড়া বেড়েছে। গতকাল রোববার যোগাযোগ করা হলে ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন পূর্বকোণকে বলেন, দুটি ইপিজেডের শ্রমিকদের কারণে আশপাশের কয়েকটি ওয়ার্ডে ভাড়া বাসার চাহিদা রয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আধা-পাকা ঘরের ভাড়াও অনেক বেশি নেন মালিকেরা।

এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ১৯৯১ সালে একটি ভাড়াটিয়া আইন হয়েছিল। কিন্তু আইনটি কারা বাস্তবায়ন করবে সেটি সুষ্পষ্টভাবে আইনে উল্লেখ নেই। ফলে জন্মতেই মৃত্যু ঘটে আইনটির। এখন কোন এলাকায় বাসা ভাড়া কত হবে, কোন ধরনের বাসায় কত ভাড়া হবেÑসেটি নির্ধারণ করার জন্য কোনো সংস্থা নেই। ২০১৫ সালে হাইকোর্ট একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেটিরও বাস্তবায়ন নেই। এর ফলে বাড়ির মালিকেরা নিজের ইচ্ছেমতো ভাড়া চাপিয়ে দেন। ভাড়াটেদের পক্ষে কথা বলবে এরকম যেন কেউই নেই।

তাই কাটগড় এলাকায় এক কামরায় শিশুপুত্রকে নিয়ে থাকা স্বামীহারা পোশাক শ্রমিক আমেনা বেগম পূর্বকোণকে বলেন, ‘ঘুমাতে গেলে দেয়ালের সঙ্গে পা লেগে যায় দশা। প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলেও বিপত্তি। কমন বাথরুমে সকাল সকাল লাইন ধরতে হয়। শুধু অফিস শেষে রাতে একটু ক্লান্তির ঘুমের জন্যই দিতে হয় তিন হাজার টাকা। কষ্টের আয় থেকে এত টাকা চলে গেলে মনকে মানানো যায় না। আমাদের সমস্যার কথা কে বলবে বলুন? পরিচয়ে আমরা যে শ্রমিক।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট