চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতেই ক্যান্সার হাসপাতাল চমেকের বাইরে হওয়া বাঞ্ছনীয়

ডা. আজাদ হাসান

১৪ নভেম্বর, ২০২০ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা দীর্ঘদিনের দাবি। সম্প্রতি সরকার চমেক ক্যাম্পাসে ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এধরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে জনমনে যুগপৎ উদ্বেগ ও শংকা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা নিরাপত্তা ও ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ক্যান্সার হাসপাতালের পারিপার্শ্বিক অবস্থা চমেক ক্যাম্পাসে নেই।

১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কালের পরিক্রমায় এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক হারে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতাল বিল্ডিংটি ধাপে ধাপে সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে একদিকে যেমন চিকিৎসা সেবার কলেবর বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ বা পোস্ট গ্রাজুয়েশন শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে হাসপাতালের কর্ম পরিধিও বিস্তৃত করা হয়েছে। খোলা হয়েছে বিভিন্ন বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে হাসপাতালের পেছনের দিকের এক্সটেনশনগুলো পরবর্তীতে মূল বিল্ডিংয়ের সাথে সংযোজন করা হয়। ফলে বিল্ডিংটির মূল সৌন্দর্য ইতিমধ্যে অনেকখানি হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে বিগত দুই দশক জুড়ে আমাদের দেশে ভার্টিক্যালি আরবান এক্সটেনশনের ফলে ক্রমাগত জনগণের চাপ এবং গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিনের অধিকাংশ সময়ই মেহেদীবাগ গোল পাহাড়ের মোড় হতে প্রবর্তকের মোড়, আর এদিকে প্রবর্তকের মোড় হতে কে বি ফজলুল কাদের রোড (অর্থাৎ মেডিকেলের মূল প্রবেশ পথ), ক্যান্টমেন্টমুখী সড়ক এবং পাঁচলাইশমুখী রোড সার্বক্ষণিক ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। অন্যদিকে জিইসির মোড়, চট্টেশ্বরীর মোড় এবং মোহাম্মদ আলী সড়ক হতে মেহেদীবাগ গোল পাহাড়ের মোড় পর্যন্ত দিনের অধিকাংশ সময়ই যানজট লেগে থাকে। যা উক্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে, এমনকি ভর্তিকৃত রোগীর স্বজনদের হাসপাতালে আসা যাওয়ার পথে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ গেল একদিকের কথা।

প্রসঙ্গক্রমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে চাই। প্রথমতঃ বায়োহ্যাজার্ড। অর্থাৎ হাসপাতাল এবং ডায়াগনসিস সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক হতে নিসৃত বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি। নগরীর ও আর নিজাম রোড, চট্টেশ্বরী রোড, গোল পাহাড়ের মোড় হয়ে প্রবর্তক মোড় হতে একদিকে কে বি ফজলুল কাদের সড়ক এবং অন্যদিকে পাঁচলাইশমুখী সড়কের উভয় পাশে ডায়গনসিস সেন্টার, ডক্টরস; চেম্বার এবং প্রাইভেট ক্লিনিক মিলিয়ে অন্ততঃ শতাধিক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসমস্ত প্রতিষ্ঠান হতে যে পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয় তা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ডিস্পোজাল করার বিধান রয়েছে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ওই সমস্ত বর্জ্য ইনসিনারেটর (অর্থাৎ জীবাণু পুড়িয়ে ধ্বংস করার বিশেষ পদ্ধতির) মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার বিধান থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। আর এই পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ না হওয়ায় আলোচ্য এলাকা ইতিমধ্যে বিষাক্ত বায়ু দূষণের রিস্কে বা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, রেডিয়েশন হ্যাজার্ডস। ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ শনাক্ত এবং রোগের প্রগনসিস মনিটর করার জন্য এক্স-রে করাসহ এমআরআই, সিটি স্ক্যান, পিইটি স্ক্যান এসব স্বীকৃত পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়। আর এগুলোতে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন ব্যবহৃত হয়। আর সে জন্য প্রয়োজন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এসব স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়সমূহকে বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে তা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে বলে আমি মনে করি।

এ রকম বাস্তবতায় ক্যান্সার হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি হাসপাতাল আবার চমেক ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে তা সংশ্লিষ্ট  মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।

ক্যান্সার হাসপাতাল মানে কেবল একটা বিল্ডিং করে কতগুলো বেড বিছিয়ে রোগীর চিকিৎসা শুরু করে দিলাম বিষয়টা এতটা সরলীকরণ করলে ভুল হবে। আমি এখানে কেবল আমার দেখা বিগত ৪৫ বছরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসের কথা উল্লেখ করেছি। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, ওই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের লোকসংখ্যা, সড়ক ব্যবস্থা, মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, মানুষের চিকিৎসা মনষ্কতা সবই পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান বাস্তবতার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এমতাবস্থায়, দেশের এবং চট্টগ্রামবাসীর স্বার্থে আমাদেরকে এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং আজ হতে আগামী ৫০ বা ১০০ বছর পর এই শহরের লোক সংখ্যা, চিকিৎসা চাহিদা এসব বিষয় গুলো বিবেচনায় নিয়ে কর্ম পরিকল্পনা করতে হবে। নতুবা এখানে আর একটি হাসপাতাল করা একদিকে যেমন জন দুর্ভোগ বাড়াবে সেই সাথে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ এবং রোগীদের কষ্ট বাড়াবে।

তাই সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনায় নিয়ে, ভিন্ন ক্যাম্পাসে ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিন। যাতে করে ভবিষ্যতে উক্ত ক্যান্সার হাসপাতালটি কেবল ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসাই দিবে না বরং অদূর ভবিষ্যতে এটি অত্র অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র ক্যান্সার ইন্সটিটিউট হিসেবে স্বকীয়তায় চির ভাস্বর রবে।

 

লেখক: ডা. আজাদ হাসান, জেনারেল ফিজিশিয়ান বেইশ হেলথ সেক্টর, জিজান সৌদি আরব।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট