চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উপকূলের মাটি এখন ‘সোনা’

তাসনীম হাসান 

১৪ নভেম্বর, ২০২০ | ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ

একসময় উপকূল বলে নাক সিটকাতেন সবাই। ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে সেখানের ঘর-বাড়ি ছেড়ে অনেকে মূল শহরের দিকে এসে স্থায়ী হন। এখন উল্টো সেই উপকূলেই ভিড়ছেন মানুষ। গড়ে তুলছেন বসতবাড়ি। নির্মাণ করছেন নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও। এই বদলের নেপথ্যে আছে শুধুমাত্র একটি সড়ক। নাম তার-‘চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড।’ পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ কাট্টলি পর্যন্ত ১৫ দশমিক দুই কিলোমিটার বিস্তৃত চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোডটি। ঘন গাছ-গাছালি আর বঙ্গোপসাগরকে পৃথক করে এগিয়ে চলা এই সড়কের পূর্ব পাশে চোখ মেললে এখন দেখা যাবে নানা ঘরবাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর কিছুর নির্মাণকাজ শেষ। আর কিছু মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ধীরে ধীরে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আউটার রিং রোডের জায়গায় আগে ছিল শহর রক্ষা বাঁধ। ষাটের দশকে নির্মিত ২০ ফুট উচ্চতার এই বাঁধটি ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে পানিতে তলিয়ে ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটে বাঁধের আশপাশের এলাকায়। এরপর ভয়ে অনেকেই সেই বাঁধঘেঁষা এলাকা ছাড়তে শুরু করেন।

তবে ২০১০ সালের পর উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালী করা, নগরীতে যানজট কমানো, আবাসন-বাণিজ্য ও পর্যটন উৎসাহিত করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাঁধের ওপর সড়ক নির্মাণ করার প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্টের সঙ্গে চুক্তি সই করে সংস্থাটি। ২০১৩ সালের আগস্টে একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটির নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই বছরের জুলাইতে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। এখনো পুরোপুরিভাবে চালু না হলেও গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ৩০ ফুট উচ্চতার সড়কটি। এই সড়ক যুক্ত হবে কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ৮৪ ফুট প্রশস্তের চার লেনের এই সড়কটির কারণে ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক কমেছে। মূলত সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হতেই বাড়তে শুরু করে আশপাশের জমির দামও। যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করায় অনেকে সড়ক ঘেঁষে বাড়িঘর নির্মাণও শুরু করেন। ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা ভারী ও কনটেইনারবাহী যানবাহন রাখার জন্য প্রয়োজন পড়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গার। ফলে গড়ে উঠে ছোট ছোট ইয়ার্ডও। জায়গার দাম কেমন বেড়েছে-সেটির স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সড়ক লাগোয়া চৌধুরী পাড়া, আব্বাসপাড়া, চৌধুরী পাড়া, ধুমপাড়া, আনন্দবাজার ও মুসলিমপাড়ার অন্তত ২০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গত ৫ থেকে ৭ বছরে জায়গার দাম দ্বিগুণে গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ আগে প্রতি গন্ডা (২ শতক) জমি বিক্রি হতো ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা। এখন সেখানে বিক্রি হচ্ছে ১৮-২০ লাখ টাকায়।

২০১৩ সালে মুসলিমপাড়া এলাকায় ১৮ লাখ টাকা দিয়ে দুই গ-া জমি কেনেন প্রবাসী জসিম উদ্দিন। সেখানে টিনের ঘর তুলে ভাড়া দেন। এতে খরচ হয় আরও প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো। ৭ বছরের ব্যবধানে ঘরসহ সেই জমির দাম উঠেছে ৫০-৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এখন দ্বিগুণ দাম পাচ্ছেন তিনি।

আনন্দবাজার এলাকায় কথা হয় গরুর খামারি মোহাম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে। এলাকার এই প্রবীণ বাসিন্দা পূর্বকোণকে বলেন, ১০ বছর আগে জমি বিক্রির জন্য ধর্ণা দিয়েও কোনো গ্রাহক পাওয়া যেত না। উপকূল বলে কেউ কিনতে চাইত না। আর এখন সড়কের জন্য উপকূলের এই মাটি সোনা হয়ে গেছে। কিনতে চেয়েও জমি পাচ্ছেন না অনেকে।

জমির দাম বাড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় আউটার রিং রোড প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের চিত্রের দিকে তাকালেও। প্রাথমিকভাবে সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হলে সংশোধিত ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ৪৯৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় বেড়ে হয় ২ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। মৌজা দর বদল হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে হয় ৭৫৫ কোটি টাকা।

জেলা প্রশাসনের কাট্টলি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে স্থানের গুরুত্বও বাড়ে। তারই প্রমাণ আউটার রিং রোডের আশপাশের এলাকা। ব্যস্ত এই সড়ক দিয়ে এখন বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দেখতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। এসব কারণে গড়ে উঠছে টার্মিনাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে ঘরবাড়ি করার প্রবণতাও বেড়েছে। জায়গার গুরুত্ব বাড়লে দাম বাড়াও স্বাভাবিক। একই কথা বলেন কাট্টলি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এহসান মুরাদও।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট