চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাগরেও দখল রাজত্ব

জেলে পেশা ছেড়ে অনেকেই এখন দিনমজুর

তাসনীম হাসান

১২ নভেম্বর, ২০২০ | ২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ঋণের বোঝা, জলদস্যু ও বহিরাগত জেলেদের উৎপাততো রয়েছেই

কয়েক বছর আগেও ধীরেন্দর জলদাসের ঠিকানা ছিল সমুদ্র। সারাবছর মাছ ধরাই ছিল তার একমাত্র পেশা। বাপ-দাদার সেই পেশা ছেড়ে তিনি এখন পুরোদস্তুর দিনমজুর। কনটেইনার ডিপোতে কাজ করছেন। এই পেশায়ও যে স্বস্তিতে আছেন তা নয়, তবে আগের মতো সেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ দশা নেই।
অবশ্য ৩০ বছরের পুরোনো পেশা শখ করে ছাড়েননি ধীরেন্দর। ঋণের বোঝা, সাগর দখল, জলদস্যু ও বহিরাগত জেলেদের উৎপাত, মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ নানা সমস্যায় পড়ে জেলে পেশা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী উত্তর পতেঙ্গার জেলেপাড়ায় ঘুরলে ধীরেন্দরের মতো অনেক উদাহরণ মেলে পথে পথে। পেশা ছাড়ার পেছনে প্রায় সবার কারণ একই।
কাটগড় মোড় থেকে পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরগামী সড়ক ধরে কিছুদূর হাঁটলেই হাতের বাম পাশে জেলেপাড়া। পাড়ার বাইরের পুরো পথজুড়ে উভয়পাশে উঁচু-নিচু দালানের সারি থাকলেও জেলেদের থাকার সামান্য আশ্রয়টুকুও বেশ নড়বড়ে, এক একটা যেন খুপড়ি ঘর। সেই পাড়াজুড়েই নেই নেই হাহাকার। জেলেদের কারও জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে এনে মানুষের মুখে তুলে দিয়ে হাসি ফোটালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করে শুধু কান্না। অভাব-অনটন যেন তাঁদের জীবনের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে।
জেলেপাড়ার মাঝামাঝিতে পড়েছে সাগর দাসের মুদির দোকান। গল্পের ছলে আড্ডা জমে যায় সাগরের সঙ্গে। সাগরের বাবা সমুদ্রের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে যাওয়ায় ভালোবেসে ছেলের নামও রেখেছিলেন সাগর। সেই আবেগ থেকে ৪০ ছুঁইছুঁই সাগরেরও ইচ্ছে ছিল জেলে হওয়ার। কিন্তু বাবার জীবনজুড়ে দারিদ্রতা দেখে আর সাগরমুখী হওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি তিনি।
সাগর বলেন, ‘এক সময় পাড়ায় ঢুকলেই মাছের গন্ধ নাকে ভেসে আসতো। ঘরে ঘরেই পড়ে থাকতো নানা মাছ। এখন দেখেন না, কোনো মাছের গন্ধ আছে? এ থেকেই বুঝে নিন কতজন মানুষ আর এই পেশায় আছেন।’
সাগরের ফোন পেয়ে একটু পরেই দোকানে আসেন সোনাবাবু জলদাস। উত্তর পতেঙ্গা জেলেপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি তিনি। আপনাদের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষোভ, দুঃখ হতাশা-সব যেন জড়ো হয় জেলেদের এই নেতার কণ্ঠে। বলতে থাকেন, পাড়ায় প্রায় ৩শ পরিবার আছে। আগে প্রতি পরিবার থেকে কেউ না কেউ সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। আর এখন গুণে গুণে ১শ জনও পাবেন না।
এভাবে পেশা ছাড়ার কারণ কী? এর জবাবে চোখ ছলছল করে ওঠে সোনাবাবুর। বলেন, ১৯৮৫ সাল থেকে সাগরে যাওয়া শুরু করেছি। কিন্তু কখনো দেখলাম না সাগর ভাগ করে দেওয়া হয়। যে যার মতো করে মাছ ধরতেন। কোনো টু শব্দটাও কেউ করতো না। সবার সঙ্গে সবার হৃদ্যতা ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি সাগরে নানা এলাকার জন্য নানা ভাগ। এর বাইরে গেলেই হুমকি-ধমকি-মারধর। সাগরজুড়ে বহিরাগত মৌসুমী জেলে আর জলদস্যুদের উৎপাত। একটু এদিক ওদিক হলেই তাঁরা জাল কেড়ে নেন, মাছ লুট করেন। ধার-দেনার বোঝা তো লেগে থাকে সারাবছর। এতকিছুর পরেও কেন এই পেশায় থাকবে বলেন?
এরপর সোনাবাবু নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন ছুঁড়েন সাগরে কোনো দেয়াল নেই। নেই কাঁটাতার। তবুও কেন এতো ভাগাভাগি?
ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে সাগরের দোকানে। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখগুলোতে শুধুই হতাশার গল্প। তাঁদেরই একজন কাশিরাম দাশ। জেলে পেশা ছাড়লেও মাছ থাকে ছাড়েনি। এখন ভ্যানে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাছ বিক্রি করেন তিনি। ৫ বছর আগে জেলে পেশা ছেড়ে ধর্মচরণ এখন দিনে এনে দিনে খান। অর্থাৎ যে কাজ পান তাই করেন। জেলেরা মনে করেন সরকারি ঋণ, সাগরে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়লে অনেকে পুনরায় জেলে পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
সাগরের দোকানের পাশ দিয়েই পশ্চিমে চলে গেছে একটি গলি। সেই গলির দু’পাশেই বস্তিসদৃশ নানা ঘর। তার একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, সোমা দাশ। এই গৃহবধূ নিজ থেকেই বলতে শুরু করেন, ‘ঝড়-বৃষ্টি উপক্ষো করে প্রতিদিন আমাদের স্বামীরা সমুদ্রে যান। আর আমরা পড়ে থাকি ঈশ^রের কাছে প্রার্থনায়। যাতে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারেন তাঁরা। এত ত্যাগ আর কষ্টের বিনিময়ে তিনবেলা ভাতও যদি কপালে না জুটে জীবনে আর কিইবা থাকে?’ সোমা দাশের এই আফসোস যেন প্রতিধ্বনিত হয় পাড়ার প্রতিটি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে।

 

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট