চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অগ্নিদুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ থেকে যায় কাগজেই

তাসনীম হাসান

১১ নভেম্বর, ২০২০ | ১:৪৯ অপরাহ্ণ

নগরীর উত্তর কাট্টলির বিশ্বাসপাড়া এলাকার ‘মরিয়ম ভিলা’ নামের একটি ভবনে বিকট শব্দের পর আগুনের ঘটনা যেন মনে করিয়ে দিল কিছুকাল আগের চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার ও পাথরঘাটার দুর্ঘটনাকে। ওই দুই দুর্ঘটনার আগেও একই রকমের বিকট শব্দ হয়। এরপর আগুন ধরে যায়। এতে অনেকেই হতাহত হন। দুই ঘটনার পরেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বেশকিছু সুপারিশ করেছিল জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মরিয়ম ভিলার ঘটনায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অথবা চুলার গ্যাস থেকে আগুন ধরেছে বলে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ( কেজিডিসিএল) কর্তৃপক্ষ কেউই তার দায় নিচ্ছে না। আগের মতোই এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপাচ্ছে। তবে বিকট শব্দের পর আগুন এবং থাই গ্লাস উড়ে যাওয়ায় অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই গ্যাস লিকেজের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন।

২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারি নগরীর দেওয়ান বাজারের নিরাপদ হাউজিং সোসাইটির মাদ্রাসা ভবনের (মাদ্রাসা নয়, ভবন) তৃতীয় তলায় রান্নার চুলার গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় দু’জন নিহত হন। বিস্ফোরণে ফ্ল্যাটের তিনটি দেয়াল উপড়ে যায়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থার আট কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ঘটনার কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি ছয়টি সুপারিশও করা হয়েছিল। সেই সুপারিশগুলো ছিল-নিয়মিত বিশেষজ্ঞ দ্বারা ভবনসহ ভবনের বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পর আবশ্যিকভাবে সুইচ বন্ধ করার জন্য মানুষকে জানানো, গ্যাস যেন জমে না যায় সেজন্য রান্নাঘরের দরজা-জানালা সবসময় আংশিকভাবে খোলা রাখতে মানুষকে বলা, ম্যানুয়েল চুলার পরিবর্তে অটো চুলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের অনুমতিপত্র গ্রহণ, উন্নতমানের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা রেখে ভবন নির্মাণে বাধ্য করা যাতে দুর্ঘটনাস্থলে ফায়ারসার্ভিস ও  অন্যান্য সংস্থা গাড়ি নিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে।

সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, কেজিডিসিএলসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনার কিছুদিন পরেই সুপারিশের কথা ভুলে যায় সবাই। এ সুপারিশ দেওয়ার পর নগরীতে এরকম আরও পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত রোববার রাত সাড়ে ৯টায় মরিয়ম ভিলায় বিকট শব্দের পর অগ্নিকা-ের ঘটনায় নয়জন দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পায়রা বেগম নামের এক বৃদ্ধা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ঘটনায় দুটি কক্ষের কাপড়চোপড় পুড়ে যায়। উড়ে গেছে জানালার থাই গ্লাসও। ঘটনার কারণ খুঁজতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।

এর আগে গত বছরের ১৭ নভেম্বর পাথরঘাটায় ব্রিকফিল্ড রোডের বড়ুয়া ভবনের নিচতলায় গ্যাসজনিত বিস্ফোরণের পর দেয়ালধসে ৭ জন নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হন। এবারও দেওয়ানবাজারের ঘটনার মতো প্রায় একই রকম পাঁচটি সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। ঘটনার পর কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন সক্রিয় ছিল। এরপর আর কারও কোনো ‘গরজ’ দেখা যায়নি।

সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটত না বলে মনে করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, আসলে তদন্তের নামে এসব সুরারিশগুলো দেওয়া হয় মানুষের চোখকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য। যেসব সংস্থা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেনি তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে হবে। তাহলেই সুপারিশ বাস্তবায়নে তারা সক্রিয় হবে।

সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। তবে তিনি বলেন, ‘গ্রাহক যদি চুলা জ্বালিয়ে ঘুমায়, সুপারিশ দিয়ে কী আর হবে? আগে গ্রাহকদেরই সচেতন হতে হবে’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট