চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মানসম্মত শিক্ষার প্রতীক্ষায় পতেঙ্গা ও হালিশহর

তাসনীম হাসান 

১০ নভেম্বর, ২০২০ | ৬:১৭ অপরাহ্ণ

হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের মানবিক বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ছে উত্তর পতেঙ্গার কাটগড়ের বাসিন্দা মেহবুবা খানম। বাসা থেকে কলেজে আসা-যাওয়া করতে প্রতিদিন তাকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ। তবে এই দূরত্বটাও কম লাগত, যদি না পথে পথে ভোগান্তি থাকত। যানজট আর কয়েক দফা গাড়ি বদলের ধকল সয়ে কলেজে পৌঁছাতে তার লেগে যায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময়। ফেরার সময়ও অপেক্ষা করে ঠিক একই কষ্ট।

শুধু মেহবুবা নয়, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ না থাকায় এভাবে ভোগান্তি নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় উত্তর পতেঙ্গা, দক্ষিণ পতেঙ্গা ও  দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের শিক্ষার্থীদের। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বেশিরভাগই এই তিন ওয়ার্ডে অবস্থিত। তাই ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দাদের পাশাপাশি এসব স্থাপনায় চাকরি করা অনেকেই সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় থাকেন।

চট্টগ্রাম নগরীতে নয়টি সরকারি বিদ্যালয় আর ছয়টি সরকারি কলেজ আছে। এসব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান বাকলিয়া, চকবাজার, জিইসি, নিউমার্কেট ও আগ্রাবাদের আশপাশের এলাকায়। মাত্র ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান হওয়ায় নগরের অন্যান্য প্রান্তের বিশাল অংশের শিক্ষার্থীরা এ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে দূরত্ব ও যাতায়াতের সমস্যার কারণে বেশি ভোগান্তি ওই তিন ওয়ার্ডের শিক্ষার্থীদের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, এই তিন ওয়াডের্র জনসংখ্যা ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৩। তবে এই কয়েকবছরে জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে দাবি জনপ্রতিনিধিদের। তিন ওয়ার্ডে বেশ কয়েকটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে। কলেজগুলোর এক-দুটির মান নিয়ে সেভাবে প্রশ্ন না থাকলেও সেখানে সবার পড়ার সুযোগ হয় না। তাই বিশাল এ জনসংখ্যার জন্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপন খুবই জরুরি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।

গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, তবুও উপেক্ষা

তিন ওয়ার্ডের অন্তত ১৫ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় পূর্বকোণের। প্রায় সবার মুখেই ছিল একই কথা। তাঁরা বলেন- বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, ইপিজেড ও কেইপিজেড, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর স্থাপনা, দেশের প্রধান তেল শোধনাগার এই ওয়ার্ডগুলোতে অবস্থিত। এসব স্থাপনা শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশেরও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে নেই কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী মেহবুবা খানমের একজন অভিভাবক মোহাম্মদ সাহেদ পূর্বকোণকে বলেন, ৯টার ক্লাস ধরতে বাসা থেকে বের হতে হয় পৌনে ৭টায়। এরপর ইপিজেডগামী শ্রমিকদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে হয়। কয়েক দফা বাস ও টেম্পো বদল করে আসা-যাওয়া করতে হয়। এত এত ধকল সওয়ার পর রাতে আর পড়াশোনা হয় না। মোহাম্মদ সাহেদ বলেন, ‘সরকারি বিদ্যালয় ও কলেজের জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছি। জানি না কখন আমাদের আশা পূরণ হবে।’

দুটি ইপিজেডে চাকরি করেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। একইভাবে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও কর্মরত আছেন হাজারো শ্রমিক। এই শ্রমিকদের অনেকের পক্ষে বেসরকারি স্কুল ও কলেজে সন্তানদের পড়ানোর সামর্থ নেই। কিন্তু বাধ্য হয়ে তাঁদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়াতে হচ্ছে। এর ফলে স্কুল-কলেজের মাসিক বেতন দিতে গিয়ে তাঁদের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

তেমনটিই জানালেন চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক আশা। কিন্তু আশপাশে কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় তাকে পড়াতে হচ্ছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এতে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনসহ নানা ফি দিতে হয়। সামান্য বেতন পান, তাঁর মধ্যে এই খরচ। বিদ্যালয়ের মান ভালো না হওয়ায়  ছেলে পড়াশোনায়ও পিছিয়ে যাচ্ছে, আবার টাকাও খরচ হচ্ছে।’ অথচ সরকারি বিদ্যালয় থাকলে সামান্য খরচে সন্তানকে ভালোভাবে পড়াতে পারতেন রোকেয়া।

একদিকে সরকারি কলেজ না থাকা, অন্যদিকে যেসব বেসরকারি কলেজ আছে সেগুলোরও মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় এলাকার বাসিন্দারা একটি ডিগ্রি কলেজ স্থাপনের জন্য একজোট হয়েছেন ।

উদ্যোক্তাদের একজন উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন পূর্বকোণকে বলেন, ‘একটি ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তিন ওয়ার্ডের সমাজসেবকদের অর্থায়নে এটি পরিচালিত হবে। পতেঙ্গার ধুমপাড়া এলাকায় প্রাথমিকভাবে একটি জায়গাও চিহ্নিত করেছি। আশা করি দুই বছরের মধ্যে আমরা সফল হবো।’

থেমে আছে আশা

উত্তর পতেঙ্গা ও হালিশহর এলাকায় দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য মোট ৪ একর জমি নির্বাচন করা হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উদ্যোগে এটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর জমি মিললেও করোনার কারণে থমকে আছে উদ্যোগটি।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ স ম জামশেদ খোন্দকার পূর্বকোণকে বলেন, ‘করোনার কারণে এই প্রকল্পের সেভাবে অগ্রগতি নেই। করোনার প্রকোপ কমলে সেটি নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করা হবে।’

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট