চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাস্ক নেই, ঠিকই আছে সেবা

ইমাম হোসাইন রাজু 

৫ নভেম্বর, ২০২০ | ১২:৫৩ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণ। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। বিচারপ্রার্থী আর আইনজীবী এবং সংশ্লিষ্টরা দৌড়ঝাঁপ করছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। নতুন আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম কর্নারে সেবা নিতে এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথায় ব্যস্ত  ছয়জন। অথচ তাদের পাঁচজনেরই মুখে ছিল না মাস্ক। এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে আদালত ভবনের তৃতীয় তলাতেও। আইনজীবীর সাথে পরামর্শে ব্যস্ত থাকা অন্তত চারজনের মধ্যে মাস্ক পরেননি তিনজনেরই। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে সালমান চৌধুরী নামে একজন পূর্বকোণকে বলেন, ‘সারাদিন মাস্ক পরে থাকতে কষ্ট হয়। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট। তাই পরা হয়নি। তাছাড়া জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি। তবে এখন থেকে নিয়মিত পরবো’।

আদালত প্রাঙ্গণসহ প্রতিটি কর্নারেই বড় করে লেখা আছে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’, ‘মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’ ইত্যাদি। কিন্তু সেবাদাতাদের মুখে মাস্ক পরার কমতি না থাকলেও সেবাগ্রহীতাদের বেশিরভাগেরই মাস্ক অনুপস্থিত। ব্যস্ততম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়সহ পুরো আদালত পাড়ার দৃশ্যে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক পরার প্রবণতা ছিল না। ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে সরেজমিনে চোখে পড়ে এমনই দৃশ্য।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘আদালত পাড়াসহ সর্বত্রই মাস্ক পরার বিষয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমাদের অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সাথে সেবাপ্রার্থীসহ অন্যদেরও। তবে নির্দেশনার পরও যদি কেউ মাস্ক না পরে থাকে, তাদের বিষয়ে একশনে যাওয়া হবে। আর আদালতের বিষয়টি আইনজীবীদের সাথে বসে নির্দেশনা দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।’

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট এএসএম বদরুল আনোয়ার পূর্বকোণকে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ সচেতনতার বিষয় যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার মাস্ক পরা নিয়ে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সঠিকভাবে তা মানা হচ্ছে না। সচেতনতা সৃষ্টি না হলে নিজেদেরই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’

শুধু আদালত পাড়াই নয়, মাস্ক পরা নিয়ে ঢিলেঢালা মনোভাব দেখা গেছে নগরীর আরও পাঁচটি সেবা প্রতিষ্ঠানেও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, রেল স্টেশন, গণপরিবহন ও কয়েকটি শপিং কমপ্লেক্স এবং ব্যাংক ঘুরে দেখা যায়, নির্দেশনার পরও এখনও মাস্ক ব্যবহারে উদাসীন সাধারণ মানুষ।

হাসপাতালে কেউ পরছেন

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক নার্সদের মধ্যে মাস্ক পরার শতভাগ প্রবণতা থাকলেও এখনও উদাসীন রোগী ও স্বজনরা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগসহ অভ্যন্তরীণ ওয়ার্ডগুলো ঘুরে এমনই দেখা গেছে। কিন্তু হাসপাতালের প্রতিটি স্থানেই ‘মাস্ক ছাড়া সেবা নেই’ এমন কিছু শব্দ উল্লেখ থাকলেও রোগী-স্বজনরা যেন তা মানছেন না। বেশিরভাগই হাতে কিংবা পকেটে নিয়ে হাটছেন। যদিও জরুরি বিভাগের প্রবেশ পথেই দেখা গেছে ভ্রাম্যমাণ কিছু মাস্ক বিক্রেতা ‘মাস্ক না পড়লে প্রবেশ করা যাবে না’ বলে মাস্ক বিক্রি করছিলেন। তবে রোগীর স্বজনরা তাতে তেমন সাড়া না দিয়ে হরহামেশাই ঢুকে পড়ছেন অভ্যন্তরর।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতাল হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। কিন্তু এখানেও যদি সাধারণ মানুষ সচেতন না হয়, তাহলে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে নিঃসন্দেহে।

রেল স্টেশন নিজেই উদাসীন

ট্রেন আসছে ট্রেন যাচ্ছে। যাত্রী-দর্শনার্থী প্রবেশ প্রস্থানতো আছেই। স্টেশন এলাকায় যারা বিধিনিষেধ করবেন, তাদেরই মাস্ক পরার বালাই নেই। দায়িত্বরত রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা, কর্মকর্তা আর কর্মচারী। নিজেরাই ঠিক মতো পরছেন না মাস্ক। গত সোমবার প্রায় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে রেলওয়ে স্টেশনে। যাত্রীদের অবস্থা তো আরও দুরাবস্থা। যদিও মঙ্গলবার সবশেষ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে মাস্ক ছাড়া টিকিট ও প্রবেশের নিষেধ করা হয়েছে। তবে গতকাল বুধবারও সরেজমিনে গিয়ে শতভাগ মাস্ক পড়ার চিত্র পাওয়া যায়নি।

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডেন্ট শফিকুল ইসলাম পূর্র্বকোণকে বলেন, ‘বেশ কয়েকবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে অস্বীকারের সুযোগ নেই, মাস্ক পরার প্রবণতা কম এটা সঠিক। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাহিনীর সদস্যদেরও কড়া নির্দেশনা দেয়া আছে। সবার জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।’

গণপরিবহণ ধার ধারছে না

এমনিতেই গণপরিবহনে নেই সামাজিক দূরত্ব। তারমধ্যে চালক আর সহকারী তো আছেই, যাত্রীদের মধ্যেও নেই মাস্ক পরার প্রবণতা। অথচ মাস্ক ছাড়া গাড়িতেও চড়া নিষেধ, কিন্তু নগরীতে চলা কোনো গণপরিবহনই এর ধার ধারছে না। যদিও কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল মেট্রোপলিটন মালিক সমিতির নিজস্ব বাস সার্ভিস মেট্রোপ্রভাতী। তাতে চালক-সহকারীর পাশাপাশি মাস্ক ছাড়া গাড়িতে তোলাতেও নিষেধাজ্ঞা করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

গণপরিবহনের এমন অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘মাস্ক দূরের কথা, এমনিতেই ৩০ আসনের গাড়িতে ৫০ জনের অধিক মানুষ ওঠে পড়ে। মালিক সমিতির সংগঠনগুলোর আসলে কার্যক্রম তেমন নেই। তাই বিষয়টিতে প্রশাসন যদি নজরদারি বাড়ায় হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসবে।’

ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই সমান

নগরীর নিউমার্কেট, জহুর হকার্স মার্কেট, আগ্রবাদ আখতারুজ্জামান সেন্টার, স্যানমার ওশান সিটিসহ বেশ কয়েকটি শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের মুখে যেমন মাস্ক নেই, তেমনি বিক্রেতাদেরও। যদিও কিছু বিপণিতে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ না করার কথা উল্লেখ করা হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের দৃশ্য চোখে পড়েনি। সেবা দেয়া-নেয়ার কাজ পুরো স্বাভাবিকই।

কিছুটা ব্যতিক্রম ব্যাংক

সরকারি-বেসরকারি অন্তত দশটি ব্যাংকে গিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম দৃশ্য চোখে পড়েছে। বেসরকারি প্রতিটি ব্যাংকেই মাস্ক ছাড়া প্রবেশে পুরোপুরিই কড়াকড়ি। উপস্থিত গ্রাহকদের প্রায় সবার মুখে মাস্ক থাকলেও কিছু কিছু কর্মকর্তার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। গলাতেই ঝুলিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংকের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। গ্রাহকরা মাস্ক ছাড়াই ঢকেছেন অনায়াসে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট