চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

২৫ লাখের পাম্প ৩ কোটি টাকায়!

ইমাম হোসাইন রাজু 

২ নভেম্বর, ২০২০ | ১:১৫ অপরাহ্ণ

সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে ২০১৬ সালে ক্রয় করে বিশেষ দুটি বৈদ্যুতিক মোটর পাম্প ক্রয় করে প্রায় তিন কোটি টাকায়। কিন্তু পাম্পগুলোর প্রকৃত বাজার মূল্য ছিল মাত্র ২৫ লাখ টাকা।

অর্থাৎ ১২ গুণ বেশি দামে এমই পাম্প দুটি ক্রয় করেছে চট্টগ্রামের শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে করা হয় কারসাজিও। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কেনাকাটায় এমনই দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য ওঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের অনুসন্ধানে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।

যাতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক আব্দুল আলিমসহ পিডিবির ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অন্যরা হলেন শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) ভুবন বিজয় দত্ত, পিডিবির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু ইউসুফ, তোফাজ্জল হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী (উপ-ব্যবস্থাপক) মিজানুর রহমান সরকার, পিডিবির প্রতিষ্ঠান নেসকো লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী এ এইচ কামাল। দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ জুন মাসে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ‘জিটি মেইন লুব অয়েল পাম্প, ইমার্জেন্সি লুব অয়েল পাম্প’ ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্রয় দপ্তর। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এমনভাবে শর্ত আরোপ করে দেন, যাতে পাওয়ার টেক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন ঠিকাদার এ কাজে অংশ নিতে পারেনি ওই প্রকল্পে। যার বিষয়ে গত বছর এ বিষয়ে অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। এরপরেই অনুসন্ধানে নামে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ।

দুদকের অনুসন্ধান তথ্য বলছে, ‘জিটি মেইন লুব অয়েল পাম্প উইথ এসি, ইমার্জেন্সি লুব অয়েল পাম্প উইথ ডিসি মোটর’ ক্রয়ের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পাওয়ার টেকের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে পিডিবি। যাতে পাম্প দুটোর মূল্য ধরা হয় ৩ লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার। যা তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী এ প্রকল্পের মোটর-পাম্পসহ যন্ত্রাংশের ঠিকাদার জার্মানের সিমেন্স থেকে সরবরাহ করেছে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকার শ্যামলী শাখার ইসলামী ব্যাংকে এলসির মাধ্যমে ভারতে টাকা পাঠায় ৩০ হাজার ১৭ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। শুধু তাই নয় জার্মানের সিমেন্স থেকে পাম্পগুলো সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে।

যদিও দুদক বলছে, নিয়ম অনুযায়ী এসব পাম্পের মূল ঠিকাদার হচ্ছে মেসার্স সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন, চীন বা সিমেন্স বা পার্কার হানিফিন গ্লোবাল, যেগুলোর কোনটা থেকেই কোন অফার চাওয়া হয়নি। অফার চাওয়া হয়েছে আলোচ্য অস্বাভাবিক দামে সরবরাহকারী মাদার কোম্পানির কাছে এবং সে কোম্পানি বাংলাদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেই দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সরবরাহকারী নিজে স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিয়েছে এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা অফার দিয়ে সরবরাহ করেছেন। শুধু তাই নয়, অসৎ উদ্দেশ্য হওয়ার কারণে টিইসি কর্তৃক দর যাচাই করে নি কমিটি।।

কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, পাম্প দুটো সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাভ ২০ শতাংশ ধরা হলেও পাম্পের খরচ দাড়ায় ৩৬ হাজার ২১ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ লাখ ১৭ হাজার ৭০১ টাকা। বাকি ৩ লাখ ২৮ হাজার ৯৭৯ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত অর্থ উত্তোলনপূর্বক আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এদিকে অভিযুক্ত তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ভুজন বিজয় দত্ত তার বক্তব্যে দুদককে জানান, পাম্পটি বর্তমানে শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভা-ারে মজুদ আছে। অর্থাৎ অতি জরুরি বিবেচনায় অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক দামে মালামাল ক্রয় করা হলেও তার অনেকটাই এখনও গোডাউনে পড়ে আছে।

দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সকলেই অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্বের লঙ্গন করে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয়ে বৈদ্যুতিক মটর ক্রয়ের নামে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বাংলাদেশ দ-বিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বর্ণিত ধারায় একটি মামলা রুজুর সুপারিশ করা হলো।

এ প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান গণমাধ্যমে জানান, পাম্প কেনা নিয়ে যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেই ব্যাপারে প্রাথমিক অনুসন্ধানকারী টিম একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তাতে অভিযোগ কিছুটা প্রমাণিত হয়েছে। কমিশন এ ব্যাপারে পরবর্তী কার্যক্রমের ব্যবস্থা নিবে।’

যদিও দুদকের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় চলতি সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় কর্তৃক মামলা দায়ের করা হবে। যার বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ চলমান আছে।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট