চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘হাইবার পানিও নাই আঁরা বাঁচি ক্যানে’

তাসনীম হাসান

৩০ অক্টোবর, ২০২০ | ১২:০১ অপরাহ্ণ

এক পাশে বঙ্গোপসাগর, অন্য পাশে কর্ণফুলী। পানির রাজ্যে থেকেও পানির অভাব দিনরাত। উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গার মানুষদের দশা যেন ব্রিটিশ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য রাইম অব এনশিয়েন্ট মেরিনার’ এর গল্পের মতো। ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরি হয়ার, নর এনি ড্রপ টু ড্রিঙ্ক’।

নগরের দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তের এই দুটি ওয়ার্ডের চিরকালীন সমস্যা পানের উপযোগী পানির। এখানের সামান্য অংশে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি যায়। নলকূপের পানিও পানের সুযোগ নেই। কারণ, এই পানি হয় আয়রণযুক্ত, না হয় লবণাক্ত। তাই জারের পানি কিনে পিপাসা মেটাতে হয় সবাইকে। আর গোসল কিংবা ব্যবহারের জন্য দৌঁড়াতে হয় এই পুকুর থেকে ওই পুকুরে। পুরুষরা তাও গোসল সারতে খোলা পুকুরে ঝাঁপ দিতে পারেন। কিন্তু নারীরা? অনেক দূরের পুকুর থেকে বালতি ভরে পানি এনে এনে জমান। এরপরেই তবে গোসল থেকে রান্নার কাজ।

চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৩ সালে। প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর পার হলেও এখনো উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে পুরোপুরিভাবে পানি পৌঁছাতে পারেনি সেবা সংস্থাটি। ওয়াসা সংস্থাটির ম্যানেজম্যান্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫৭ বছরে নগরের মাত্র ৫৭ শতাংশ নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছে সংস্থাটি। ওয়াসার পানি না যাওয়ায় সুপেয় পানির জন্য তাই নিত্য হাহাকার থাকে এই দুই ওয়ার্ডে। বর্তমানে দুই ওয়ার্ডের ৮০ শতাংশ মানুষেরই পানির জোগান দেয় গভীর নলকূপ, পুকুর-জলাশয় আর কিনে নেওয়া পানির জার।

সম্প্রতি দুই ওয়ার্ডে অন্তত ২০ জন মানুষকে- ‘আপনাদের প্রধান সমস্যা কী?’ এই প্রশ্ন করা হলে-সবার কাছ থেকেই উত্তর আসে একটাই। সেটি হলো সুপেয় পানির অভাব।

উত্তর পতেঙ্গার পূর্ব কাটগড় এলাকায় পাওয়া গেল বৃদ্ধ আবদুল হককে। পানের উপযোগী পানি নেই? কীভাবে পানির পিপাসা মেটান? এমন প্রশ্নের উত্তরে যেন ক্ষোভের খই ফুটল বৃদ্ধের কণ্ঠে। গজগজ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে থাকেন, ‘পানির আরেক নাম নাকি জীবন। এডে খাইবর পানিও নাই। যেগিন পানি আছে সেগিনই আয়রণ। ভাত রাধিলে রং দেখি মনে হয়, খিঁচুড়ি। আঁরা মানুষগুন বাঁচি ক্যানে’।

নলকূপের পানি লবণাক্ততার জন্য মুখে নেওয়া যায় না। তাই দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের বিপুল পরিমাণ মানুষের পানির চাহিদা মেটানোর ‘দায়িত্ব নিয়েছে’ রাজার পুকুর। এই পুকুরে দিনভর গোসল করতে আসা মানুষের জট লেগে থাকে।

দক্ষিণ পতেঙ্গার চৌধুরীপাড়া এলাকার সড়কে চোখ রাখতেই দেখা গেল- ভ্যানে করে জারভর্তি পানি নিয়ে ছুটছেন অনেকেই। সেখানে কথা হয়, ভ্যানচালক রহিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নেভি গেট ও বন্দরটিলা থেকে ওয়াসার পানি কিনেন। তারপর তা জারে ভরে বিক্রি করেন। ২০ লিটারের একটি জার ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।

আবার নিরাপদ পানি না থাকায় ওয়ার্ডের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠেছে অবৈধ পানি উৎপাদন কারখানাও। সেগুলোর পানি কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সেই প্রশ্ন তুলেছেন ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইনও। তিনি পূর্বকোণকে আরও বলেন, ‘ওয়াসা দাবি করে সব জায়গায় পানি দিচ্ছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখেছি পতেঙ্গার মানুষ তাদের পানি পান না।’
আশার বাণী

ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম পূর্বকোণকে বলেন, এখন তাঁরা রেশনিংয়ের মাধ্যমে পতেঙ্গায় দিনে দেড় কোটি লিটার মতো পানি সরবরাহ করছেন। বর্তমানে মদুনাঘাট প্রকল্পের অধীনে পতেঙ্গায় পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। করোনার কারণে সেই কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেছে। কাজ শেষ হলে ৩ থেকে ৪ কোটি লিটার পনি সরবরাহ করা যাবে।
তবে শুধু ওয়াসার পানির দিকে না তাকিয়ে এই দুটি ওয়ার্ডে চাইলে বৃষ্টির পানিকে সুপেয় পানি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি এ দুটি ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থের স্তর বৃদ্ধির সম্ভাবণাও রয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়শা আখতারের নেতৃত্বে নগরে হওয়া দুটি গবেষণা সেটিই দেখিয়ে দিয়েছে।

অধ্যাপক ড. আয়শা আখতার পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওয়ার্ড দুটিতে বৃষ্টির পানিকে সুপেয় পানি হিসাবে ব্যবহার ও ভূ-গর্ভস্থের স্তর বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। উপযুক্ত পদক্ষেপ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা গেলে দুটি ওয়ার্ডের মানুষের কষ্ট কমানো যাবে’।

দুই ওয়ার্ডের মানুষ-এই আশার আলো যেন পূর্ণতা পায় সেই আশায় আছেন।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট