চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমার যেন চাঁদ দোলে...

ইসলামের আলোকধারা

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমার যেন চাঁদ দোলে…

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৯ অক্টোবর, ২০২০ | ১১:৩৭ অপরাহ্ণ

বারো-ই রবিউল আউয়াল। কুল মাখলুকাতের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে তিমির আকাশে উদিত হয়েছিল এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র- আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে পুর নূর (সা) এ বিশ্বচরাচরে তাশরীফ আনেন। তার শুভাগমনে এ পৃথিবী থেকে হাজার বছরের গোমটবাঁধা জুলমাত ও অন্ধকার বিদূরিত হয়, সমূদয় অজ্ঞতা ও পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আরব আযমে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। মানব-দানব, পশু-পাখি তামাম সৃষ্টিকূলে সেদিন নেমে এসেছিল পরম স্বস্তি, শৃঙ্খলা, সাম্য, শান্তি ও পারস্পারিক মমত্ববোধের পরিবেশ।

আমাদের ঐতিহ্যের ভাষায় এদিন পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা)। আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পুর নূর (সা) এর মহান জন্মোৎসব। এ উৎসব অবিস্মরণীয় অতুলনীয়, চিরঞ্জীব চির সজীব। মানবতা যেন এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সে অপেক্ষমান দিনটি। সকলের পক্ষ থেকে কবি নজরুল তাই গেয়ে ছিলেন-
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে;
মধু পূর্ণিমারই যেন চাঁদ দোলে/যেন উষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।

সেদিন পৃথিবীতে যেমন রাহমাতুল লিল আলামীনের শুভ আগমনে ঈদের আনন্দ বয়ে গিয়েছিল, উদ্বেলিত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল গোটা কায়েনাত; আমরাও আজ সেদিনের স্মরণে পরম আনন্দ উপলব্ধি করছি, শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আলাহ পাক সুবহানাহু তায়ালার। অযুত কণ্ঠে সালাত ও সালাম জানাই নবী করিম (সা) এর পাক চরণে।

আমাদের মহান জাতীয় কবি নবীপ্রেমিক নজরুল আজকের এ মহান দিবস উপলক্ষে সুন্দর বলে গেছেন-
‘নাই তাজ, তাই লাজ- ওরে মুসলিম খর্জুর শীষে তোরা সাজ /উরজ য়্যামান নজদ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম, /মেসের ওমান তেহরান-স্মরি কাহার বিরাট নাম, পড়ে সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম।’

অবশ্য আলাহপাকের রহমত ও নবীজীর হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পবিত্র জীবনের অলৌকিকত্ব যে এই দিনেই তিনি মদীনায় হিজরত করেছিলেন এবং ৬৩২ খিস্টাব্দের এদিনে আবার তামাম মাখলুকাতকে শোকসাগরে ভাসিয়ে ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

হাদীস শরীফে এসেছে : নবীজীর পয়দয়েশ উপলক্ষে আজ থেকে প্রায় ১৪’শ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মানব-দানব জীব-জন্তু গাছ-পালা সবকিছু আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। ৬৩ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের এদিন তিনি আবার ওফাতপ্রাপ্ত হন। আলাহতায়ালার সান্নিধ্যে চলে যান। হাদীস শরীফে এসেছে : আঁ হযরতের তিরোধানে সেদিন আকাশ বাতাস হয়ে পড়েছিল মেঘাচ্ছন্ন ও শোকাতুর।

মহানবী (সা) এর জন্ম ও ওফাতের এ দিবসে আমরা ঈদে মিলাদ্ন্নুবী (সা) উদযাপন করে থাকি। এদিন, এ মৌসুমে স্মরণ করি তার পবিত্র জীবনাদর্শ, ত্যাগ ও মহত্ব। তিনি গোটাজীবন তাওহীদ বা মহান আলাহতায়ালার কালেমার দাওয়াত দিয়ে মানুষকে সৎপথের আহবান জানিয়েছেন। তাঁর হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল মানবজাতির আদর্শ ও হিদায়াত। দূর করেছিলেন শিরক-বিদআত গোমরাহি আর জুলমাতের কালিমা। আমরা আজ স্মরণ করি তার হাতে গড়া মদীনা রাষ্ট্র, তার পুণ্যাত্মা সাহাবাদের আত্মত্যগে প্রতিষ্ঠিত খিলাফতে রাশেদা। আমরা উপলব্দি করি তার রেখে যাওয়া কুরআন-সন্নাহ ও সাহাবাদের আদর্শের মধ্যেই আমাদের সকলের জন্য নিহিত রয়েছে অফুরন্ত দুনিয়াবী কল্যাণ ও শান্তি এবং আখিরাতে নাজাত ও পুরস্কার।

মহান আলাহপাক ইরশাদ করছেন- ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দু:খ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল দয়াময়। এতদসত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে হে প্রিয় নবী! আপনি বলে দিন: আলাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী নেই। আমি তারই ভরসা করি এবং তিনি মহান আরশের অধিপতি।’ (সূরা তাওবা আয়াত ১২৮ ও একশত ২৯)।

এ আয়াত দুটোতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর দুনিয়াতে তাশরীফ আনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তামাম জাহানের জন্য রহমত ও দয়ার আধার হয়ে প্রেরিত। বিশেষ করে বিশ্বাসিদের জন্য একজন মহা মঙ্গলকামী পথনির্দেশক। আমাদের উচিত মহান আরশের অধিপতি আলাহপাকের সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে এবং দুনিয়া আখিরাতের ভালায়ির জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করা, সর্বাধিক ভালবাসা নিবেদন করা এবং জীবনে সর্বক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ কর।

সূরা আহযাব আয়াত ৫৬ ও ৫৭ ইরশাদ হচ্ছে: ইন্নালহা ওয়া মালায়িকাতাহু ইউ সাল্লূনা আলান্নাবী’ই… আলাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ তোমরা নবীর জন্য রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি যথাযথ সালাম প্রেরণ কর। যারা আলাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় , আলাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।

উপরোক্ত আয়াতের আসল উদ্দেশ্য, মুসলমানদেরকে রাসূলে খোদা (সা)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করার আদেশ দান করা কিন্তু তা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রথমে আলাহ স্বয়ং নিজের ও তাঁর ফেরেস্তাগণের দরূদ পাঠানোর কথা উলেখ করেছেন। অত:পর সাধারণ মু’মিনগনকে দরূদ প্রেরণ করার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর মাহাত্ম্য ও সম্মানকে এতো উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে যে, আঁ-হযরত (সা)-এর শানে যে কাজের আদেশ মুসলমানদেরকে দেয়া হয় সে কাজ স্বয়ং আলাহ ও তাঁর ফেরেস্তাগণও করেন।

অতএব যে মু’মিনগণের প্রতি রাসূল (সা)-এর অনুগ্রহের অন্ত নেই তাদের তো এ কাজে খুব যত্নবান হওয়া উচিৎ। এ বর্ণনাভঙ্গির আরো একটি উপকারিতা এই যে, এতে করে দরূদ সালাম প্রেরণকারী মুসলমানদের একটি বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কেননা আলাহতায়ালা তাদের এমন এক মহতী কাজে শরীক করে নিয়েছেন যা তিনি নিজেও করেন এবং তাঁর ফেরেস্তাগণও। আবদুলাহ ইবনে মাসুদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করেছে।’

সাহাবী উবাই ইবনে কা’ব (রাদি) বর্ণনা করেনঃ আমি হুজুর (সা)-এর খিদমতে আরজ করলাম যে, ইয়া রাসূলালাহ (সা)! আমি আপনার খিদমতে অনেক দরূদ পাঠ করি। আপনি বলে দিন যে, নিয়মিতভাবে আমি আপনার প্রতি কতবার দরূদ পাঠ করবো? হযরত (সা) জানালেন; যত তোমার ইচ্ছা। অতঃপর আমি আরজ করলাম যে, আমার অজিফার জন্য নির্ধারিত সময়ের এক-চতুর্থাংশ সময় আমি আপনার উপর দরূদ পাঠ করতে চাই। প্রিয় নবী (সা) ইরশাদ করলেনঃ যতক্ষণ তোমার খুশী পাঠ কর। তবে আরো কিছু সময় বৃদ্ধি করতে পারলে তা তোমার জন্য হবে কল্যাণকর। আমি আরজ করলামঃ তাহলে মোট সময়ের অর্ধেক।’ জবাবে আলাহ তায়ালার প্রিয় হাবীব বললেনঃ যা তোমার ইচ্ছা। তবে যদি আরো কিছু সময় বৃদ্ধি কর, তা তোমার জন্য আরো ভাল হবে।’ আমি আরজ করলাম যে, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ সময় ধরে পড়ব।’ হযরত (সা) এবারও জানালেন: যা তোমার খুশী।’ তবে আরো কিছু সময় বাড়াতে পারলে তা তোমার জন্য আরো ভাল হয়।’ আমি এবার জানালামঃ আমার উপর অজিফার সবটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পড়ে অতিবাহিত করতে চাই। প্রিয় নবী (সা) ইরশাদ করলেনঃ এমন অবস্থায় তোমার সকল ভাবনা ও প্রয়োজনীয় হাজত পূরণ করা হবে এবং তোমার সকল গুণাহ মাফ করা হবে। (তিরমিজী শরীফ)।

রাসূল (সা) এর পবিত্র পয়দায়েশ ওফাতের এ মহান দিবসে আমাদেরকে নবীজীর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানার জন্য নতুন করে প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। তার হায়াতে তাইয়্যিবা আমাদের জন্য ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ-দুনিয়ার জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর আদর্শ ও পথনির্দেশ। তার স্মরণ আমাদের জন্য বরকত, তার উপর দরূদ ও সালাম পেশ করা আমাদের দুনিয়া আখিরাতে নাজাতের উসিলা।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর পবিত্র বিলাদাত ও ওফাতের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালে আমরা বেশি বেশি করে তাঁর শানে, তাঁর আহলে বায়ত ও সাহাবা কেরামের শানে দরূদ ও সালাম নিবেদন করব।

লেখক: অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট