চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অবরোধ, যানজটে দুর্ভোগ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হাজার হাজার জেলের বিক্ষোভ

নিজস্ব সংবাদদাতা, সীতাকু

১০ জুন, ২০১৯ | ২:০৩ পূর্বাহ্ণ

হ জেলেদের মাছ ধরার সুযোগ
দেয়ার দাবিতে স্মারকলিপি
হ সাংসদসহ ডিসির
কার্যালয়ে বৈঠক

মে-জুলাই মাসের টানা ৬৫দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধে সরকারি নির্দেশনা প্রত্যাহারের দাবিতে সীতাকু-ের ফৌজদারহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেড় ঘণ্টা অবরোধ করেছে ক্ষুব্ধ জেলেরা। গতকাল (রবিবার) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত এ অবরোধকালে উভয় দিকে প্রায় ২০ কি. মি. দীর্ঘ যানজটে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে স্থানীয় এমপিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে অবরোধ প্রত্যাহার হয়।
সরেজমিনে গতকাল (রবিবার) সকাল আনুমানিক ১০ টায় সীতাকু-ের ফৌজদারহাট বাংলাবাজার পোর্ট কানেকটিং সড়কে গিয়ে দেখা যায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে শুরু করে মিরসরাইয়ের ৩৮টি জেলে গ্রামের কয়েক হাজার জেলে নারী-পুরুষ বিভিন্ন যানবাহনে করে সীতাকু-ের ফৌজদারহাট বাংলাবাজার লিংক রোডে এসে জড়ো হয়। এরপর তারা প্রথমে মহাসড়কের পাশে মানববন্ধন ও পরে সাড়ে ১০টার দিকে মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। তারা বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানারে মাছ ধরা বন্ধে সরকারি নির্দেশনার প্রতিবাদে বিভিন্ন সেøাগান তুলে ধরে এবং মাছ ধরা বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এসময় তাদের সাথে এসে ঐক্যমত পোষণ করেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল পালিত, সীতাকু- উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বিমল নাথ, সাধারণ সম্পাদক স্বপন বণিক, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রঞ্জিত সাহা, সুলাল দাশ সুনীল, সজল নাথ, সুমন দাশ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব চন্দ্র দে প্রমুখ।
এতে এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, মৎস্যজীবীদের ঘোর মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধের এ সিদ্ধান্তে জেলেরা চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। তাই জেলেদের আন্দোলনের সাথে আমিও একমত। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না হলে আগামী ১১ জুন থেকে গণঅনশন কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
এদিকে অবরোধ কর্মসূচি চলার কারণে উভয় দিকে চট্টগ্রামের অলংকার থেকে ভাটিয়ারী পর্যন্ত প্রায় ২০ কি.মি. দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। এসময় ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী হাজার হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। থেমে যায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানির অসংখ্য গাড়িও। সরেজমিনে পরিদর্শনকালে ভাটিয়ারীতে দাঁড়িয়ে থাকা চট্টগ্রামমুখী এস.আলম পরিবহনের এক যাত্রী মো. আবু হানিফ বলেন, ঢাকা থেকে সীতাকু-ের ভাটিয়ারীতে এসে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা এক জায়গায় আটকে আছি। গাড়ি এক পা’ও সামনের দিকে যাচ্ছে না। এটা যে কত বিরক্তকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। আরো বিরক্ত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী স্টার লাইন পরিবহনের এক যাত্রী মো. ছালে আহমদ। তিনি বলেন, বাসটি চট্টগ্রামের অলংকার ছেড়ে ৫ মিনিটের মধ্যে সিটি গেট এলাকায় এসে পৌঁছায়। কিন্তু এরপরেই যানজটে আটকে পড়ি। এখানে এক ঘণ্টারও বেশি সব গাড়ি থেমে আছে। এভাবেই সমস্যায় পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা যাওয়াকারী অসংখ্য পণ্যবাহী গাড়িসহ বিভিন্ন প্রকার যানবাহন। এমনি অবস্থার খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছান সীতাকু-ের এমপি আলহাজ দিদারুল আলম, ইউএনও মিল্টন রায়, এসিল্যান্ড মাহবুবুল হক এবং এডিশনাল এসপি (হেডকোয়ার্টার) মো. জাহাঙ্গীর আলম, এডিশনাল এসপি (দক্ষিণ) মো. টুটুল, এডিশনাল এসপি শম্পা রানী সাহা, ওসি (তদন্ত) মো. আফজাল হোসেন, ওসি (ইন্টিলিজেন্স) সুমন বণিক, সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ, ভাটিয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দিন।
এমপি দিদারুল আলম তাদেরকে নিয়ে আজকের (গতকাল রবিবার) মধ্যেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে জেলেরা বেলা পৌনে ১২টায় অবরোধ প্রত্যাহার করে। পরে জেলে প্রতিনিধিসহ এমপি দিদারুল আলম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান।
উত্তর চট্টলা উপকূলীয় জলদাশ কল্যাণ সমবায় ফেডারেশনের সভাপতি লিটন দাশ বলেন, আগে ইলিশের মৌসুমের পর মা মাছ ধরা বন্ধে সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হতো। আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার হটাৎ করে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা বন্ধ রাখার নির্দেশ এসেছে। এ সময়টা ইলিশের মৌসুম। মাছ ধরা বন্ধ রাখলে বিভিন্ন এনজিও ও দাদনদারের ঋণে জর্জরিত হয়ে থাকা জেলেরা ঋণ মুক্ত হতে পারবে না। ফেডারেশনের সহ-সভাপতি উপেন্দ্র জলদাশ ও সহ-সাধারণ সম্পাদক দুলাল জলদাশ বলেন, সরকার আমাদের মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়ে চাউল দিতে চায়। কিন্তু আমরা তো চাল চাইনি, কাজ করতে চেয়েছি। কাজ করার সুযোগ দিন। এটাই আমাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম। মৎস্য কর্মকর্তা, চেয়ারম্যানসহ সবাই আমাদেরকে পরিবার পিছু মাসে ৪০ কেজি করে চাউল দিয়ে চেয়েছেন। আমরা নিইনি। তারা মে-জুলাইয়ের ৬৫ দিনের পরিবর্তে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
এদিকে এমপি আলহাজ দিদারুল আলম বলেন, জেলেদের দাবির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা আলোচনা করার আশ্বাস দেওয়ার পর তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেছে। আমরা চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধান করতে।
ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলেরা সকাল সাড়ে ১০টা থেকে মহাসড়কে মানববন্ধন ও অবরোধ করে। পরে তা প্রত্যাহার করেছে। এখন মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন রায় জানান, দুপুরে স্থানীয় এমপি দিদারুল আলমসহ তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি মিটিং করেন। এসময় জেলা প্রশাসক মহোদয় জেলেদের স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে পাঠান। অচিরেই এ বিষয়ে একটি সন্তোষজনক সমাধান আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
জেলা প্রশাসকের কাছে মিরসরাইয়ের জেলেদের স্মারকলিপি
মিরসরাই : নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মাসে ৪০ কেজি হারে সহায়তার চাল নিয়েও মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে নারাজ মিরসরাইয়ের জেলারা। তারা সরকারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে গতকাল (রবিবার) মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। এ নিয়ে তারা আন্দোলনে নামার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে।
জানা গেছে, মাছের প্রজনন রক্ষায় বছরে অন্তত দুই মাস সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরার ব্যাপারে জেলেদের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকে। যথারীতি এবারও মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
গত মে মাসে সরকারিভাবে এখানকার দুই হাজার ৩১ জন জেলের মাঝে সহায়তা হিসেবে ৪০ কেজি করে চাউল বিতরণ করা হয়। সরকারি হিসেবে চলতি মাসে আরও ৪০ কেজি পরিমাণ চাউল জেলেদের দেয়ার কথা রয়েছে। এদিকে গতকাল (রবিবার) এখানকার কয়েক’শ জেলে স্থানীয় উপজেলা সদরে দল বেধে এসে সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দেয়। এসময় তারা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া হলে প্রয়োজনে আমরা আন্দোলনে যাব’।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল হক সেতু বলেন, ‘সন্দ্বীপ চ্যানেলটি গভীর সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। গভীর সমুদ্রে জাল ফেলে যেসব জেলে মাছ আহরণ করে তাদের মাছ ধরা থেকে বিরত রাখার জন্য সরকারি সহায়তায় উপজেলার ২ হাজার ৩১ জন জেলের মাঝে প্রতিজনকে মে মাসে ৪০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। জুন মাসেও চাল বিতরণ করা হবে’।
তিনি আরো জানান, জেলেরা সরকারি সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করে পুনরায় সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা কার্যকর করা হবে।
স্থানীয় জেলে সর্দার বাদল চন্দ্র দাস জানান, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকাকালীন সময়ে খালে বেহুন্দা জাল ও টং জাল ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে তারা আজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
স্মারকলিপি দিতে আসা কয়েকজন জেলে জানান, উপজেলার ডোমখালী, সাহেরখালী, মির্জানগর, জয়নগর, হাদিনগর, মঘাদিয়া, বামনসুন্দর, বাঁশখালী, পাতাকোট জেলেপাড়া মিলে মিরসরাইয়ে প্রায় ৫ হাজার জেলে সমুদ্রে জাল ফেলে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। দুই মাস মাছ ধরতে না দেয়ার কারণে এখন সবাই অভাব অনটনে জীবন যাপন করছে।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, জেলেরা আমার মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছে। আমি চিঠিটি জেলা প্রশাসক মহোদয় বরাবরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এছাড়া সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট