চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সুদীপ্ত হত্যার বিচার দেখে মরতে চান বাবা মেঘনাথ

নাজিম মুহাম্মদ

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:৪০ অপরাহ্ণ

বেঁচে থাকতে ছেলে হত্যাকারীদের বিচার দেখতে চান অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস। নগর ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। সুদীপ্ত হত্যার তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে। আগামী মাসে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত থাকার দায়ে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ছেলে হত্যাকারীদের বিচার করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি লিখিত দাবি জানিয়েছেন বাবা মেঘনাথ। জীবদ্দশায় ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান অবসরপ্রাপ্ত এ স্কুল শিক্ষক।
২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর ভোরে নগরীর সদরঘাটের নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে সুদীপ্তকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শুরুতে মামলাটি নগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করলেও ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এটি তদন্ত করতে পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করে সিএমপি। ছেলে হত্যার বর্ণনা দিয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে থানায় মামলাটি দায়ের করেছিলেন মেঘনাথ বিশ্বাস। আগামী ১২ অক্টোবর সুদীপ্ত হত্যা মামলা শুনানির ধার্য্য তারিখ রয়েছে।
পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানান, মামলা তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসে (অক্টোবর) এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার চেষ্টা করছি আমরা।
সুদীপ্ত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম, জিয়াউল হক ফয়সাল, ইব্রাহিম খলিল, মামুনুর রহমান রাব্বি, রাজিবুল ইসলাম, জাহিদুর রহমান ওরফে জাহেদ, সালাউদ্দিন লাভলু, রুবেল কান্তি দে ওরফে চশমা রুবেল, আইনুল কাদের নিপু, আমির হোসেন বাবু, খাইরুল নুর ইসলাম, ফয়সাল আহমেদ পাপ্পু, মোক্তার হোসেন, হানিফ ওরফে পিচ্চি হানিফ, মিজানুর রহমান, হানিফ ও নিজাম উদ্দিন রুবেল। এদের মধ্যে রুবেল, মিজানুর ছাড়া অন্যরা জামিনে বের হয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুঠোফোনে ধারণ করা সুদীপ্তকে পিটানোর ভিডিও, আওয়ামীলীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুমের সম্পৃক্ত থাকার অডিও রেকর্ডসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামতের ফরেনসিক প্রতিবেদন এসে পৌঁছেছে পিবিআই’র হাতে। হত্যার সময় ব্যবহৃত আটটি সিএনজি ট্যাক্সি শনাক্ত করা হয়েছে। দুটি মোটর সাইকেলের একটি উদ্ধার করা হয়েছে।
সন্তানহারা বাবার আর্তনাদ : মেঘনাথ বলেন, ২০১৭ সালের ছয় অক্টোবর আমার সুখ-শান্তি, আশা-ভরসা, সর্বস্ব হারানোর দিন। লালখান বাজারের এক বড় ভাইয়ের নিদের্শে একদল তারই পালিত হায়েনা লোহার রড, হকিস্টিক, চাপাতিসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার ছেলেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছেলেটির শরীরে এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে অমানুষিকভাবে আঘাত করা হয়নি। যন্ত্রনাদগ্ধ ছেলেটা অনবরত বাঁচার আশায় আকুতি জানিয়ে চিৎকার কান্নাকাটি করেছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। নরপশুরা তাকে মেরে চলে গেল।
আমার ২৭/২৮ বছর ধরে গভীর মমতা, ভালবাসা ও আশা-ভরসার প্রতীক ছেলেকে হত্যা করে আমাদের বুক খালি করা সেই নির্দেশদাতা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। গ্রেপ্তারের দুই মাসের মাথায় সেই বীরপুরুষ জামিনে বের হয়ে আবার নিজ সাম্রাজ্যে ফিরে এসেছেন। তারও আগে খুনে জড়িত অন্য আসামি সবার জামিন হয়ে গেছে। এখন আমি আমার পরিবার নিয়ে খুবই শংকিত অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ২০১৩ সালে অবসর গ্রহণের পরে ভরসা ছিল ছেলে চাকরি করবে, আমার আর কষ্ট থাকবে না। পিটিয়ে মারার ছয় মাস আগে সে একটা চাকরিতে যোগদান করেছিল। তারপর তাকে মেরে ফেলা হলো। ইতোমধ্যে টাকা পয়সা যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। কোথায় লালখান বাজার আর কোথায় নালাপাড়া। নেতার নির্দেশে নালাপাড়া এসে আমার ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে দিবালোকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। নেতা জামিনে বের হবেন, এটা আগেই জানতাম। দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। শুধু যন্ত্রণা হয় যখন ফেসবুকে হঠাৎ ভিডিওতে ধারণকৃত আমার ছেলেকে নির্মমভাবে পিটানো অবস্থায় মা মা করে আর্তনাদ আর কান্না কানে অবিরাম অনুরণিত হয়ে আমাকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে। মেডিকেলে ছেলের বেঁচে থাকার আকুতি। ডান হাত ভাঙ্গা। থেতলানো বাম হাতটা দিয়ে মাকে ধরতে গিয়ে কোনভাবে তুলতে না পারা, মাঝে মাঝে বুকফাটা আর্তনাদ। পিটানোর সময় ছেলেটার গগণ বিদারী আর্তনাদ, সারা শরীরে রক্তক্ষরণ হওয়া অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরানো, মাঝে মাঝে বাবারে, মরে যাচ্ছি, বাঁচাও বলে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার। চোখে মুখে বেঁচে থাকার সে কি আকুলতা। ছেলের গায়ের রক্তে আমার শার্ট ভিজে উঠা। তখন শেষবারের মতো চোখের পানি ছেড়ে দেয়া। হাত দিয়ে বারবার কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করা এবং তারপর নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। পিতা হিসাবে নিজের ছেলেকে অসহ্য যন্ত্রণায় ধীরে-ধীরে মৃত্যুকে বরণ করাটা দেখেছি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট