চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

দুঃসময়েও এমন অনিয়ম!

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ৫:২১ অপরাহ্ণ

সহযোগী একটি পত্রিকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের করোনা আইসোলেশন সেন্টারের কেনাকাটায় ‘বালিশ কাণ্ডের’ খবর পড়ে বড় একটা ধাক্কাই খেলাম। করোনার যখন উচ্চ সংক্রমণ চলছিল, চট্টগ্রামের কোন হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানোর মতো বেড ছিল না- তখন এই সেন্টারটি প্রতিষ্ঠা করেছিল সিটি কর্পোরেশন। নাগরিক-বান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চসিকের এই উদ্যোগে অনেকেই বাহবা দিয়েছেন। বড় কিছু না হোক, অন্ততঃ উপসর্গের রোগীরা করোনা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই আইসোলেশন সেন্টারে থেকে প্রাথমিক ধকলটা সামলে নিতে পারবেন- এই ভরসায় কিছুটা স্বস্তি পান নগরবাসী। যদিও কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামে ব্যক্তি ও সামষ্টিক উদ্যোগে আরও কয়েকটি আইসোলেশন সেন্টার ও ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেগুলোর পাশাপাশি চসিকের মতো প্রতিষ্ঠান করোনা রোগীদের সেবায় এগিয়ে আসায় নগরবাসীর মনোবল চাঙা হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য রোগীর সংখ্যা কমে আসায় সিটি কর্পোরেশন আইসোলেশন সেন্টারটি বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু পিলে চমকানোর মতো ব্যাপার হল- নতুন প্রশাসক দায়িত্ব নেয়ার পর এই আইসোলেশন সেন্টারের আয়-ব্যয়ের হিসেব তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ে, এই সেন্টারের কেনাকাটা নয়-ছয় হয়েছে। সেন্টারের জন্য মগ, বালতি, গ্যাস সিলিন্ডার, থার্মোমিটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা হয়েছে দুই থেকে তিনগুণ দামে। তাও আবার বিনা দরপত্রে। রেওয়াজ থাকলেও নেয়া হয়নি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের স্টোর শাখার মাধ্যমে জিনিসপত্রগুলো কেনা হয়। অভিযোগ ওঠেছে, এই বিভাগের সংশ্লিষ্টরা চট্টগ্রামের বড় একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সরঞ্জামের দর নিলেও কেনাকাটা করে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকার মেসার্স এবি কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী ছাড়াও পূর্ত কাজ, স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য আবাসন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতেও বিপুল অংকের ব্যয় হয়েছে। এসব খাতে অনিয়ম হয়েছে কিনা, সে হিসেব এখনো চলছে। সব মিলিয়ে এই আইসোলেশন সেন্টারের পেছনে তিন মাসে কি পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, তার মোট হিসেব এখনও পাওয়া না গেলেও চসিক প্রশাসক জানিয়েছেন, আড়াই কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এখানে।
সহযোগী ওই পত্রিকার খবরে আরও বলা হয়েছে, ২১ জুন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় আড়াইশ শয্যার এই সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়। রোগীর অভাবে ১৪ আগস্ট বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে ১২৯জন রোগী সেন্টারটি থেকে সেবা নিয়েছেন। রোগীদের সেবা প্রদান করেন ১৫ চিকিৎসকসহ ১০৪ স্বাস্থ্যকর্মী।
সিটি কর্পোরেশনের আলোচ্য আইসোলেশন সেন্টারটি পরিচালনায় কী পরিমাণ অনিয়ম হয়েছে, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে নগরীর বড়পুলের কাছে আরও একটি আইসোলেশন সেন্টারের কথা জানাতে চাই। যেটি সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ১৩ জুন শুরু হয়েছিল। আর্থিক অনটনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সেন্টারটি বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর হালিশহর পোর্ট কানেক্টিং সড়কের পাশে সম্পূর্ণ জনগণের আর্থিক অনুদানে একটি কমিউনিটি সেন্টারে ১শ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটি স্থাপিত হয় একটি ছাত্র সংগঠনের কিছু প্রাক্তন ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ ও তাদের শুভানুধ্যায়ীদের উদ্যোগে। বন্ধ করে দেয়ার আগে হালিশহরের এই আইসোলেশন সেন্টার কর্তৃপক্ষ আয়-ব্যয়ের যে হিসেব উপস্থাপন করেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়, তিন মাসে ৭৬৫ জন রোগীকে বিনামূল্যে সেবা হয়েছে। ১২জন চিকিৎসকসহ ২১ জন স্বাস্থ্যকর্মী এবং ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই তিনমাস সেন্টারে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে গেছেন। সেন্টারটি পরিচালনায় তাদের ব্যয় হয়েছে মোট ৫৪ লাখ টাকা।
পুরো বিষয়টি সংক্ষিপ্ত করলে যা দাঁড়ায়, তাহলো- আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট আইসোলেশন সেন্টার পরিচালনায় তিন মাসে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আড়াই কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সেবা পেয়েছেন ১২৯ জন রোগী।
অন্যদিকে, হালিশহরের একশ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটিও তিন মাস পরিচালনা করে প্রায় ছয়গুণ রোগী অর্থাৎ ৭৬৫ জনকে সেবা প্রদান করে। প্রায় সমান সুবিধা দিয়েও তাদের ব্যয় হয় মাত্র ৫৪ লাখ টাকা।
পার্থক্যটা এখানেই। ব্যক্তি উদ্যোগে অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এক পঞ্চমাংশ টাকায় যে কাজটি করা গেছে নীরবে এবং সুষ্ঠুভাবে সেটি গণমুখী একটি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকগুণ বেশি টাকায় কেন করতে হল, এর জবাব চায় নগরবাসী।
করোনার উচ্চ সংক্রমণকালে হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে একটু শ্বাস নেয়ার জন্য চট্টগ্রামবাসী যখন ছটফট করছিল, একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছিল- তখন মানুষের মনে বড় আশার আলো জ্বালিয়ে বড় পরিসরে আইসোলেশন সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু করোনাকালের এমন সংকটেও দুর্বৃত্তরা লোভ সংবরণ করতে পারে নি। নিজেদের পকেট ভারী করতে অনিয়মের মাধ্যমে মানুষের করের টাকা লোপাট করায় মেতে ওঠেন। যারা এই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে মানবিক উদ্যোগকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন, তাদের কৃতকর্ম জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার। এজন্য যতোটা কঠোর হওয়া দরকার, তাতে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। কেন অনুমতি ও দরপত্র ছাড়া পণ্য সরবরাহে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে সিটি কর্পোরেশনকে ধরা দিতে হল, সেটিও বের করা দরকার। অনিয়মে কারা কারা জড়িত, তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়া দরকার। সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক নাগরিকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিবেন না। নগরবাসী প্রশাসকের কাজে এর প্রমাণ চান।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট